মিয়ানমারের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এত বেশি প্রভাব কেন?

সানজিদা হোসেন

ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪, ০১:১৭ পিএম

মিয়ানমারের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এত বেশি প্রভাব কেন?

ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বেশিভাগ সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রেখে আসছে সেনা শাসনের অধীনে। ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন বর্তমান শাসক ও সেনাপ্রধান মিন অং লাইং।

প্রশ্ন উঠেছে যে, মিয়ানমারে এত দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে সামরিক বাহিনী তাদের আধিপত্য বজায় রেখে আসছে? ভবিষ্যতেও তারা এই অবস্থা বজায় রাখতে যাচ্ছে কী!

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির চেয়ে বেশি পুরনো’। 

স্বাধীনতার পর মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। ফলে সেনাবাহিনী দাবি করে, দেশটিকে ঐক্যবদ্ধভাবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার পর নানা সমস্যায় পড়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী উ নু সেনাবাহিনীকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। ফলে সেনাবাহিনীর প্রভাব আরও বেড়ে যায়। এমনকি ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও সামরিক জেনারেলদের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ডেভিড আই স্টেইনবার্গ ‘দ্য মিলিটারি ইন বার্মা/মিয়ানমার’ নামে তার বইয়ে লিখেছেন, সামরিক বাহিনী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কখনও ধরে রেখেছে বিভিন্ন ডিক্রি জারি করে, রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংবিধানে বিধি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে।

কত বছর শাসন করেছে সামরিক বাহিনী?

অধ্যাপক ডেভিড আই স্টেইনবার্গ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কখনোই যে গণতন্ত্র চায়নি তা তাদের শাসনকাল পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। মিয়ানমারের স্বাধীনতার ৭২ বছরের মধ্যে তারা ডিক্রি জারির মাধ্যমে শাসন করেছে ৩৭ বছর।

সাংবিধানিক ক্ষমতার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে ১৯ বছর , এবং ২০১৬-২১ পর্যন্ত পাঁচ বছর শাসন ক্ষমতায় নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ ছিল। সে হিসেবে মাত্র ১২ বছর দেশটির শাসন ক্ষমতা বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে ছিল, যদিও সেই সময়েও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যা “তাতমাদোও” নামে পরিচিত, তারা আধুনিক এশিয়ার সবচেয়ে এলিট ও দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা বাহিনী। ‘তাতমাদোও’-এর অর্থাৎ, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা যত বেড়েছে, এর পরিসরও বেড়েছে।

১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিল এক লাখ ১০ হাজার। ১৯৬৫ সালে বেড়ে গিয়ে হয় এক লাখ ৪০ হাজার। তারপর ১৯৮৮ সালে এটি দুই লাখ এবং ১৯৯৯ সালে এটি বেড়ে চার লাখে দাঁড়ায়।

সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা পাঁচ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য ছিল। এছাড়া আরও ৮০ হাজার পুলিশ সদস্যও সামরিক বাহিনীর অধীনে ছিল। সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিল বৌদ্ধ এবং বার্মান জাতিগোষ্ঠীর।

২০১৪ সালে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা সরকারের মোট ব্যয়ের ১৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে  দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের সাড়ে চার শতাংশ ছিল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

মিয়ানমারের স্বাধীনতার কারিগর এবং বর্তমান গ্রেফতারকৃত সাবেক স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সান ১৯৪০-এর দশকের শুরুর দিকে বার্মা ন্যাশনাল আর্মি নামে একটি সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী বছরগুলোতে সামরিক বাহিনী ব্যাপক জনসমর্থন পায় কারণ তাদেরকে এমন একটি বাহিনী হিসেবে দেখা হয় যারা দেশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর মূল দায়িত্ব ছিল কমিউনিস্ট এবং জাতিগত সহিংসতা দমন করা এবং দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। সামরিক বাহিনী সবসময়ই নিরাপত্তাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে এভাবে তারা একটি “প্যারানয়া সিকিউরিটি কমপ্লেক্স” বা নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের ‘ভ্রান্ত ভয়’ সৃষ্টি করেছে যা এখনও চলছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

Link copied!