উত্তর কোরিয়ার যে ক্ষেপনাস্ত্র এখন আমেরিকার জন্য মাথাব্যথার কারণ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ২৬, ২০২২, ০৫:২৫ পিএম

উত্তর কোরিয়ার যে ক্ষেপনাস্ত্র এখন আমেরিকার জন্য মাথাব্যথার কারণ

উত্তর কোরিয়া নতুন ধরনের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) পরীক্ষা করেছে। চার বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো কিম জং উনের দেশ। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের আবহে এই অস্ত্রের মহড়া নতুন এক বার্তা দিল বিশ্বকে। বিশেষ করে এটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। কারণ আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের মতো ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, অন্য কোনো দেশের হাতেও নেই!

এর আগেও দেশটি ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু শুক্রবারের পরীক্ষাটি ছিল নানা দিক দিয়েই ব্যতিক্রমী। এদিন টিভি ভিডিওতে দেখা যায়, হলিউডের অ্যাকশনধর্মী ছবি ‘টপ গান'-এর মতো করে অ্যাকশনের ভঙ্গিতে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালান উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন৷

একটি ভিডিও শুক্রবার প্রকাশ করে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল৷ তাতে দেখা যায়, স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল দরজা৷ গায়ে লেদারের চকচকে জ্যাকেট, চোখে সানগ্লাস আর দুই পাশে দুই সেনা কর্মকর্তা নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে আসলেন কিম জং উন৷ ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তুলে দিলেন নির্দেশনা৷ এরপরই উড়ে গেল ক্ষেপনাস্ত্রটি!

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম শুক্রবার বলেছে, কিম জং উন এর সরাসরি নির্দেশনায় এদিন ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এ ক্ষেপণাস্ত্রের কোড নাম হোয়াসোং-১৭। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র এটি। প্রতিবেদনে উৎক্ষেপণকে ‘শক্তিশালী পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধক’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিমকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়ার বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের জন্য ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’। এটিকে বলা হচ্ছে ‘দৈত্যাকার ক্ষেপনাস্ত্র।’

Kim Jong Un in black leather jacket and sunglasses and flanked by two men in military uniform walking away from a white-coned missile on its transporter

হোয়াসোং-১৭ আকারে বিশাল। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের যে কোনো স্থান এখন উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ওয়ারহেডের আওতায় চলে এল। অবশ্য পারমাণবিক পে-লোড সরবরাহের ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্রটির সক্ষমতা সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু অপ্রকাশ্য। 

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নতুন ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ছবিও প্রকাশ করেছে। পিয়ংইয়ং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি মোবাইল লঞ্চার থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এতে ব্যবহার করা হয়েছে তরল-জ্বালানি। উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ এবং দীর্ঘতম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এটি। 

কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রটি সর্বোচ্চ ৬ হাজার ২৪৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার উচ্চতায় উঠেছিল এবং ১ হাজার ৯০ কিলোমিটার উড়েছে। যেখানে একটি আন্তঃমহদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ধরা হয় ৯ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার থেকে ১৪ হাজার ৯৬৭ কিলোমিটার। পরিকল্পনা অনুযায়ী পানিতে অবতরণের আগে এটি ৬৮ মিনিট পর্যন্ত উড়েছে। কোরিয়ান উপদ্বীপ এবং জাপানের মধ্যবর্তী আকাশে এ ক্ষেপণাস্ত্র উড়েছে। জাপানি পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে কোরীয় সংবাদমাধ্যমের হিসাব মিলে যাচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি জাপানের এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। 

North Korea carries out 'very important test' - BBC News

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র অনেক উঁচুতে উড়তে সক্ষম, ফলে রাডার ফাঁকি দিয়ে নির্বিঘ্নে অন্য দেশের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে পারবে। একটি আইসিবিএমের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনুভূমিক গতিপথে উড়লে এটি সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র এর নাগালের মধ্যে থাকবে। 

মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেফরি লুইস মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘এটি উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র।’ 

হোয়াসোং-১৭ ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ। শুক্রবার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি।

হোয়াসোং-১৭ ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ। শুক্রবার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হোয়াসোং-১৭ একটিতো বটেই, সম্ভবত একাধিক পারমাণবিক অস্ত্র বহন করার জন্য যথেষ্ট বড়। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যা ঘটল তা হলো, যুদ্ধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেড তাক করার সক্ষমতার দিকে উত্তর কোরিয়া সুনিশ্চিত অগ্রগতি দেখাল। 

অনেকে অবশ্য বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা মানেই প্রকৃত ক্ষমতা নয়। বৃহস্পতিবারের পরীক্ষায় ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভাব্য পাল্লা দেখানো হলেও বিশেষজ্ঞরা জানেন না এটি কী ধরনের পেলোড বহন করছিল। শেষ পর্যন্ত পেলোডের ওজন একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লাকে প্রভাবিত করে। ফলে এ তথ্য ছাড়া পর্যবেক্ষকেরা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রকৃত পাল্লা নিশ্চিতভাবে জানতে পারবেন না। 

বিশেষজ্ঞরা আর উল্লেখ করছেন, পিয়ংইয়ং দেখায়নি যে তারা এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম কি না যা পারমাণবিক ওয়ারহেডকে অক্ষত অবস্থায় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশ করতে দেয়। 

আইসিবিএম মূলত স্পেস শাটল বা স্পেস ক্যাপসুলের মতো। এটি খাড়া মহাকাশে ছোড়া হয়। তার মানে ভূমিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে হলে ওয়ারহেডকে অবশ্যই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরের স্তরগুলোর মধ্যে দিয়ে যাত্রার সময় সৃষ্ট বিপুল তাপের মধ্যে অক্ষত থাকতে হবে। ওয়ারহেডে এই তাপ সহ্য করার মতো ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেটি উত্তর কোরিয়ার আইসিবিএমে আছে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া সেই অর্জনে অনেকখানি এগিয়ে গেছে তা নিশ্চিত।

 North Korea unveils giant ICBM during pre-dawn military parade, World News  | wionews.com

নেতা কিম জং উন উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক হামলা প্রতিরোধ সক্ষম করে তোলার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। তাঁর লক্ষ্য নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্রের নির্ভুলতা বাড়ানো এবং ১৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লা বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। 

সূত্র: এপি, এএফপি ও রয়টার্স

Link copied!