ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আফগানিস্তানের অর্থনীতি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ২৭, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আফগানিস্তানের অর্থনীতি

গত অক্টোবরের শেষ দিকে আফগানিস্তানের একই পরিবারের ৮ সন্তান ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে মারা যায়। এদের মধ্যে সবেচেয়ে ছোট সন্তানের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। পরিবারটি প্রথমে শয্যাশায়ী বাবাকে হারায়। অল্পদিন পরেই শোকে কাতর মা-ও তাদের ছেড়ে পারি দেয় পরপারে। বাধ্য হয়ে খাবারের সন্ধানে তাদের রাস্তায় নামতে হয়। প্রতিবেশীরা প্রথমদিকে তাদের দুই এক টুকরো রুটি, পানি দিয়ে সাহায্য করলেও ক্রমশ প্রতিবেশীদের ভাঁড়ারেও টান পরতে থাকে। ফলে সেদিক থেকে সাহায্যও বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা সবাই একে একে মারা যায় খাবারের অভাবে।

স্বাভাবিক সময় হলে হয়তো ঘটনাটি হৃদয়বিদারক-মর্মান্তিক ঘটনা বলে প্রতিভাত হতো কিন্তু বর্তমানে আফগানিস্তানের যে অবস্থা তাতে খাবারের অভাবে এই ৮ জনের মৃত্যু বরং স্বাভাবিক ঘটনাই।

এর আগে, গত ২৫ অক্টোবর জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছিল, আফগানিস্তান স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। সেসময় বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি সিরিয়া ও ইয়েমেনের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট বলছে, আফগানিস্তানের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নেই। পর্যাপ্ত সাহায্য না পাঠানো হলে আসন্ন শীতে এই সংকট আরো প্রবল হয়ে ধরা দেবে বলেও ওই রিপোর্টে বলা হয়।  

আফগানিস্তানের এই দুর্ভিক্ষ একদিনে আসেনি। দীর্ঘ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে এই দুর্ভিক্ষ হাজির হয়েছে দেশটিতে। ধারাবাহিক ক্ষরা ও যুদ্ধ দেশটির বেশিরভাগ নাগরিককে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে। তার উপর কোভিড-১৯ মহামারি এবং লকডাউন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে এসেছে। বিশেষ করে গৃহস্থালী চালাতে গিয়ে তীব্র সংকটের মুখে পড়েছে প্রতিটি পরিবার। গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়তে আরম্ভ করে।

জাতিসংঘের অনুমান, দেশটির অর্ধেকের বেশি নাগরিকের দৈনিক আয় ১.৯ ডলারেরও কম। ২০২২ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটি দেশটির নাগরিকের ৯৭ শতাংশকে ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ, দেশটির ৯৭ শতাংশ নাগরিকের দৈনিক আয় দাঁড়াবে ১.৯ ডলার বা তারও কম।

এবিষয়ে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) কর্মকর্তা কানি ভিগনারাজা গত ২১ অক্টোবর বলেছেন, “বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে এমন ভয়াবহ আকারের বিপর্যয় আমরা দেখিনি।”

এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের তাৎক্ষণিক কারণ হলো, দেশটি থেকে বৈদশিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া। এই বৈদশিক সাহায্যের উপরই আফগানিস্তানের অর্থনীতি টিকে ছিল। তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে, দেশটি প্রতিবছর কমপক্ষে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বিদেশী সাহায্য পেত। যা দেশটির মোট জিডিপির ৫ ভাগের ২ ভাগ। দেশটির শিক্ষা-চিকিৎসা খাতসহ সরকারী বাজেটের ৪ ভাগের ৩ ভাগ আসতো বিদেশী সাহায্য হতে। এমনকি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করে চলতো।

কিন্তু গত ১৫ আগস্ট দেশটির সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে এসব বিদেশী সাহায্য দুম করে থেমে গেছে। বিদেশী সাহায্য বন্ধের পাশাপাশি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ফলে, দেশটিতে ২ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের বেতন-ভাতাসহ বিশাল অঙ্কের সরকারি বেতন-ভাতা বকেয়া রয়ে গেছে।

দেশটিতে বৈদশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সরবরাহ না থাকায় দেশটির পক্ষে বিদেশী লেনদেন পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে; বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। এছাড়াও, অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের আশঙ্কায় দেশটির বৈদশিক বাণিজ্যও বন্ধ হওয়ার পথে। বিদেশী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আফগানিস্তান থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে। তাদের ভয়, নতুন তালেবান সরকার তাদের ব্যবসা কব্জা করে নিতে পারে।

ফলে, যা হয়েছে, দেশটিতে নগদ টাকার অভাব এবং ক্রমবর্ধমান নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে দ্রুত বেগে। কারণ, দেশটির অর্থনীতি এখন আর কোন নিয়ম কানুনের উপর চলছে না। একেবারেই অনানুষ্ঠানিকভাবে (পুরনো আমলের মুদ্রা ছাড়া লেনদেন) চলছে লেনদেন।

ফলে, দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা আসলে কতোটা খারাপ তা যথাযথভাবে নির্ণয় করা বেশ কঠিন। ইতোমধ্যে দেশটিতে অনানুষ্ঠানিক লেনদেন এবং তারই সূত্র ধরে কালোবাজারি বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, দেশটির অধিকাংশ নাগরিকের পক্ষে নিত্য প্রয়োজন মেটানোও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাবুলর অধিবাসীরা তাদের ঘরের জিনিসপত্র রাস্তার পাশের খোলা কালোবাজারে বিক্রি করছে যাতে তারা খাবার ক্রয় করতে পারে। এমতাবস্থায় আইএমএফ ধারণা করছে, আগামী মাসের মধ্যেই দেশটির জিডিপি অন্তত ৩০ শতাংশ কমে যাবে।

তবে, এত দুঃসংবাদের মধ্যেও একটুখানি আশার আলো আছে যে, হয়তো দেশটির এমন ভয়াবহ অবস্থা খুব দ্রুতই শেষ হবে। দেশটির ক্ষমতায় থাকা তালেবান সরকার, আন্তর্জাতিক মহলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, দেশটিতে আর সুইসাইড বোমা হামলার কোন ঘটনা তালেবানরা ঘটাবে না। বিনিময়ে রেড ক্রসসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালাতে সম্মত হয়েছে। তবে, তারা আগের অর্থায়নের মাত্র এক তৃতীয়াংশ দেশটিতে দেবে। ইতোমধ্যে, দেশটির সাবেক দাতা সংস্থ-দেশগুলো তাদের মনযোগ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায়, আফগানিস্তানের সামগ্রিক অবস্থা আমলে নিয়ে রেড ক্রস ইন্টারন্যাশনালের রবার্ট মারদিনি বলেছেন, “কোন একটি দেশের অর্থনীতি কখনো মানবিক সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা দিয়ে চলতে পারে না।”

পরিহাসের বিষয় হলো, ক্ষমতা দখলের সময় তালেবান যেমনটা বলেছিল তারা একটি অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠন করবে, নারীর ক্ষমতায়নসহ আরও বেশকিছু বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেগুলো বাস্তাবায়ন করা ক্রমশ তালেবানের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে। ফলে, তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর মনোভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি।

তবে, সবচেয়ে বড় পরিহাসের বিষয় হলো, আফগানিস্তানে তালেবানকে ক্ষমতা দখল করতে দিয়েছে পশ্চিমারাই। এখন তারাই আবার দেশটির সম্পত্তি জব্দ করে রাখছে, তাদের বেসরকারি সহায়তা প্রত্যাহার করেছে। ফলে, দেশটির অর্থনিীতি যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এবং দেশটিতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় আসন্ন তখন পশ্চিমা নেতারা দেশটির ধ্বসে পড়া দূর থেকে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে এমনই মনে হচ্ছে।

(দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে) 

Link copied!