মে ২৬, ২০২৩, ০৮:৫০ পিএম
জলজ্যান্ত মানুষ গলায় কথা বলা মানুষ হলেও নিজের পরিচয় দেন ‘জিনের বাদশা। প্রবাসীর স্ত্রীকে ফোন করে প্রবাসী স্বামীর সামনে বড় বিপদ, তাঁর মৃত্যুও হতে পারে। আবার ফোন করে বলা হয় তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে পারবে ‘পরিস্থানের’ লোকেরা। এছাড়াও এমনকি সোনার মূর্তি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে দেয় লোহার তৈরি মূর্তি। এরকম নানারকম জিনের বাদশা পরিচয়ে পাবনায় এক গৃহবধূকে ফাঁদে ফেলে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা এবং ১ লাখ ২০ হাজার টাকার স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রের সদস্যরা।
পাবনার আদালতে এক গৃহবধূর করা একটি নালিশি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ওই গৃহবধূকে প্রথমে স্বামীর মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে বিকাশে ৩০ হাজার টাকা নেয় প্রতারক চক্র। প্রথম দফায় সফলতা আসায় তিন দিন পর আবার ওই নারীকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তারা।
কাপড়ে মোড়ানো সোনালি রঙের একটি পুতুল দিয়ে চক্রের সদস্যরা তাঁকে বলেন, এটি পরিস্থানের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। এই পুতুল নতুন পাতিলে রেখে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখার ১৫ দিন পর পাতিলভর্তি স্বর্ণ পাওয়া যাবে। এভাবে কৌশলে এবার ওই গৃহবধূর কাছ থেকে আরও মোটা অঙ্কের টাকা ও সোনার গয়না হাতিয়ে নেন তাঁরা। গৃহবধূকে যে পুতুলটি দেওয়া হয়েছিল, সেটিও ছিল লোহার।
এ মামলার তদন্ত শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে পিবিআই। তাঁরা প্রতারণায় জড়িত চক্রটির তিন সদস্যকে শনাক্ত করেছে। তাঁরা হলেন- ওয়াসিম মণ্ডল (৩০), সানোয়ার হোসেন (৩৯) ও সৈয়দ লুৎফর রহমান (৩৮)। তাঁদের মধ্যে ওয়াসিম মণ্ডল ও সানোয়ার হোসেনের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। আর লুৎফর রহমানের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুরে।
পিবিআই জানায়, ফাঁদে ফেলার আগে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ওই গৃহবধূর সাথে ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের অ্যাপ ইমোতে যোগাযোগ করেন। চক্রের সদস্যরা তখন বুঝতে পারেন, গৃহবধূ পীর-ফকির বিশ্বাস করেন। তাই জিন ও পরীর গল্প বলে তাঁকে ফাঁদে ফেলা সম্ভব হবে বলে বুঝতে পারেন।
পাবনা জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) উপপরিদর্শক সোহাগ আলী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে মুঠোফোনে জানান, ২০২১ সালের দিকে প্রবাসীর স্ত্রী ওই গৃহবধূ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েন। ২০২২ সালের মার্চে তিনি নালিশি মামলা করেন।
তিনি জানান, গৃহবধূর কাছ থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই নারী প্রতারকদের দুই দফায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন, তা তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ঘটনায় তিনজনকে শনাক্ত করা হলেও তাঁরা এখন পলাতক। এখন কোর্টের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।
গৃহবধূর ভাষ্য অনুযায়ী, মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের একটি মাধ্যমে টাকা নেওয়ার পর প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলেছিলেন, বিষয়টি যেন কাউকে না জানানো হয়। এ কথা কাউকে জানালে তাঁর (গৃহবধূ) স্বামী মারা যাবেন বলে ভয় দেখানো হয়। কথিত পরিস্থান থেকে জিনের বাদশাহ মানুষের রূপ ধারণ করে তাঁর (গৃহবধূ) সাথে একটি বাজারের পাশে দেখা করবেন বলে জানান। তখন জিনের বাদশাহ তাঁকে একটি স্বর্ণের পুতুল দেবেন বলা হয়। এ জন্য গৃহবধূকে তাঁর স্বর্ণের চেইন ও হাতের বালা নিয়ে যেতে বলা হয়।
প্রতারকেরা তাঁকে এমন করে মগজধোলাই করেন যে তাঁরা যা বলছিলেন, সবই সত্যি মনে হচ্ছিল। স্বর্ণের পুতুল পাওয়ার আশায় তিনি স্বর্ণের চেইন ও বালা নিয়ে এক ব্যক্তির সাথে দেখা করেন। তখন তাঁকে (গৃহবধূ) লাল কাপড়ে মোড়ানো একটি ভারী পুতুল দেখিয়ে বলা হয়, এটি পরিস্থানের স্বর্ণের পুতুল। এই পুতুল পাতিলে ভরে ১৫ দিন মাটির নিচে রেখে দিলে পুরো পাতিল স্বর্ণে ভরে যাবে। এই পুতুল তাঁকে দেওয়া হবে— এমন আশ্বাস দিয়ে স্বর্ণের চেইন ও বালা নিয়ে যান ওই ব্যক্তি।
ভুক্তভোগী নারী আরও জানান, এ ঘটনার পর গভীর রাতে তাঁকে মুঠোফোনে জানানো হয়, ‘পরিস্থান’ থেকে পরিরা তাঁর জন্য স্বর্ণের পুতুল নিয়ে এসেছে। ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁকে আবারও দেখা করতে বলা হয়। এবার তিনি ব্যাংক থেকে ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করেন। তখন ওই ব্যক্তি গৃহবধূকে বলেন, টাকাগুলো কচুগাছের নিচে রেখে পুতুলটি যেন তিনি গ্রহণ করেন। ওই গৃহবধূ ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা কচুগাছের নিচে রেখে সেই পুতুল নিয়ে বাসায় চলে আসেন। কথিত জিনের বাদশাহর কথামতো ওই গৃহবধূ পুতুলটি নতুন পাতিলে ভরে ১৫ দিন মাটির নিচে রেখে দেন। তবে ১৫ দিন পর পাতিল খুলে তিনি দেখেন, সেখানে কোনো স্বর্ণ নেই। পরে পরীক্ষা করিয়ে দেখেন তাঁকে যে পুতুল দেওয়া হয়েছে, সেটিও লোহার তৈরি।