দিনশেষে পরিবারই মানুষের শান্তি ও নিরাপদ জায়গা। কী মায়ায় বা কোন সুতায় পারিবারিক সম্পর্কগুলো বাঁধা থাকে, তা বলা কঠিন। পরম মায়াময় এই পরিবারই অনেক সময় বিষময় হয়ে ওঠে। পরিবারে আপন মানুষের দ্বারাই নির্যাতিত হন অনেকে। এর চেয়ে বেদনা জগতে আর কী বা হতে পারে?
আমাদের সমাজ কাঠামো যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, ফলে বেশিরভাগ সময় নারীরাই এই নির্যাতনের শিকার হন। সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে ক্রমেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় প্রভু ও দাসীর। অথচ বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে দুজন নারী-পুরুষের একসঙ্গে সুখে বসবাস। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হবেন, প্রিয়তম বন্ধু হবেন।
বড় আফসোসের বিষয় হল, এই একবিংশ শতাব্দীর উত্তরাধুনিক যুগেও আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতি নারীর প্রতিকূলেই। অবস্থা দেখে মনে হতে পারে, নারীকে নির্যাতন করার জন্যই যেন অনেক পুরুষ বিয়ে করেন! সুখে-শান্তিতে ঘরকন্যা করা তো দূরে থাক, স্বামীর ঘরে সামান্য স্বস্তিটুকুও মেলে না তাদের। বিয়ের পরই স্ত্রীরা স্বামীদের দুচোখের বিষ হয়ে ওঠেন হঠাৎ। স্ত্রীদের কোনো কিছুই আর তাদের পছন্দ হয় না। যত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে পড়ে ওই স্ত্রীর ওপর। শুধু স্বামীই নন, তাকে নির্যাতনে ঐকতান গড়ে তোলেন স্বামীর পরিবারের সদস্যরাও। চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি আরও দুটি বর্বর ঘটনা প্রত্যক্ষ করল দেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যু হল স্বামী নামের এক খুনীর হাতে। এলমার পরিবারের অভিযোগ, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তিলে তিলে নির্যাতন করে এলমাকে হত্যা করেছে। জানা যাচ্ছে, মৃত্যুর আগের দিনও এলমা শ্বশুরবাড়ি থেকে পালাতে চেয়েছিলেন, পারেননি।
চট্টগ্রামেও ঘটল একই ধরনের ঘটনা। যৌতুকের দাবীতে স্বামীর নির্যাতনে মারা গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাহমুদা খানম। বিয়ের পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতন।
মফস্বল ও গ্রামে নারী নির্যাতন খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনায় পরিণত হয়েছে বহু আগে থেকেই। যৌতুকের বলি হয়ে বহু নারীর জীবন গেছে স্বামী নামের অপুরুষদের হাতে। যৌতুক প্রথা শহরে তেমন নেই। নারী নির্যাতনও শহরে একটু কম ছিল। কিন্তু ইদানিং এই সত্য মানতে কষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার দুটিই ঘটেছে শহরে। আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে নির্মমতার বলী দুজনই উচ্চশিক্ষিত নারী এবং তাদের সামাজিক অবস্থাও ভালো। তাদের স্বামীও উচ্চশিক্ষিত। তারপরও স্বামীর নির্যাতনে প্রাণ দিতে হলো তাদের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপার্সন তানিয়া হক বলেন, “যারা নিম্নবিত্ত তাদের ঘরেই কেবল নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, এটি ভুল ধারণা। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেও এই সমস্যা প্রকট। তবে অনেক সময় এগুলো জানা যায় না। সামাজিক ও পারিবারিক ইমেজের কথা ভেবে এই শ্রেণীর নারীরা মুখ খোলেন না।”
মেয়েসন্তানের জন্ম দেওয়ায় নির্যাতন
ছেলে ছেলে করে আমাদের দেশে কত নারীর জীবনে যে দুঃখের অমানিশা নেমে এসেছে, কত সংসার যে ভেঙেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যেভাবেই হোক তাদের ঘরে ছেলে চাই-ই চাই।
ছেলে জন্ম না দেওয়ায় অতীতে অনেক নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। অনেক মেয়েকে তাদের স্বামীরা তালাক দিয়েছেন। অনেক মেয়ে সতীনের সংসার করছেন। এমনকি অনেকে খুনও হয়েছেন। যদিও সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তার জন্য কোনোভাবেই নারীরা দায়ী নন।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতাতেও মুক্তি নাই
বলা হয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীমুক্তির প্রধান উপায়। কিন্তু সাম্প্রতিক নানা ঘটনা এ কথাকেও হার মানালো। উচ্চশিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী ও সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকা নারীরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
গেল সপ্তাহে অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া বিচ্ছেদের এক বছর পর সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন । সেখানে তিনি লিখেছেন, স্বামী নির্যাতনের কারণে তার হাতও ভেঙে যায়।
স্বামীর নির্যাতনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরের কথা যেমন আমরা ভুলিনি, তেমনি প্রতিদিনই যেসব ঘটনা আমাদের সামনে হাজির হয়, সেগুলোও অগ্রাহ্য করার কোন উপায় নাই। সমাজের সব স্তরে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছেই।
শিক্ষক তানিয়া হক বলেন “নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার ব্যাপারগুলো নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে আলাদা ফর্মে থাকে। যেমন: নিম্নবিত্তরা বলে যৌতুক আর উচ্চবিত্তদের কাছে তা হলো গিফট। এই যৌতুক বা গিফটের বোঝা টানতে হয় মেয়ের বাবাকে। কারণ সমাজ মনেই করে মেয়ের বাবাকে নিচে থাকতে হবে।”
অনেক নারীর কাছে স্বাভাবিক!
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ এর একটি গবেষণায় দেখা যায়, দেশের প্রতি চারজন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেন। এই নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। স্বামীর অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়া; বাচ্চাদের প্রতি যত্নশীল না হওয়া; স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা; যৌন সম্পর্ক করতে অস্বীকৃতি জানানো এবং খাবার পুড়িয়ে ফেলা—এই পাঁচটি কারণের অন্তত একটির জন্য ওই নারীরা মার খান। আর তারা স্বামীর হাতে মার খাওয়ার এই কারণগুলোকে যৌক্তিক মনে করেন।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ নারী ওপরের কারণগুলোর জন্য স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেন।
রক্ষক যখন ভক্ষক
যেকোন বিপদে পড়া মানুষ সবার আগে খোঁজে বাঁচার পথ। এজন্য দেশে রয়েছে আইন-আদালত। প্রশ্ন হলো, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীও যদি বিপদকে আরও ঘণীভূত করে তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?
পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট বেশিরভাগ নারী আইনের আশ্রয় নিতেও ভয় পান। তারপরও যে কয়েকজন সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করেন তাদের কপালে জোটে কালিমা। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো ভুক্তভোগীকেই দায়ী করা হয়। ধর্ষক দিনের পর দিন বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিচার হয় না। আর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায় আমাদের তনুরা।
এমনকি আইনের পোশাক গায়ে জড়ানো ব্যক্তিরাও কখনও কখনও ধর্ষক হয়ে ওঠেন। স্বামীর হাত থেকে বাঁচতে সরকারি জরুরি সেবার নম্বরে ফোন করে সাহায্য নিতে পুলিশের কাছে গিয়েও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে দেশে!
সমাজে দীর্ঘদিন থেকে চলা বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষকে ধীরে ধীরে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সেই সঙ্গে আইনের প্রয়োগ নিয়েও দেখা দেয় সন্দেহ। যে কারণে সঙ্কট কাটছে না, ঘোরতর হচ্ছে।
সমাধান কোন পথে?
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক আইন ও নীতিমালা হয়েছে। কিন্তু নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে কী? আসলে শুধু আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করে এ সমস্যার সমাধান হবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কেন না, এটা এক ধরনের সামাজিক বৈধতা পেয়ে গেছে। স্ত্রী নির্যাতনকে আর অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না।
এক্ষেত্রে শিক্ষক তানিয়া হক জোর দিয়েছেন পারিবারিক শিক্ষার ওপর। তিনি বলেন, “পরিবার হলো মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব শেখানোর আসল জায়গা। সন্তানকে কেবল ডিগ্রিধারী বিদ্বান বানালেই চলবে না। ছোটবেলা থেকে শেখাতে হবে নৈতিকতা। তা না হলে এসব ঘটনা থামবে না। রাষ্ট্র কেবল আইন প্রয়োগ করতে পারে।”
(লেখার মতামত একান্ত লেখকের)