শেখ হাসিনাকে চাপপ্রয়োগ না করতে মার্কিন সরকারের কাছে তদবির করেছিল ভারত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ১৬, ২০২৪, ১২:৪১ পিএম

শেখ হাসিনাকে চাপপ্রয়োগ না করতে মার্কিন সরকারের কাছে তদবির করেছিল ভারত

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপপ্রয়োগ বন্ধ করার জন্য মার্কিন সরকারের কাছে ভারতীয় কর্মকর্তারা তদবির করেছিল। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানানো হয়।

বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জেলে পাঠানোর ঘটনায় মার্কিন সমালোচনার মুখে পড়ে শেখ হাসিনার সরকার। এর আগে র‌্যাবের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে কয়েকজনের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, যারা গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করেছে বা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

আরও পড়ুন: উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা: আসিফ মাহমুদ

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের সময় ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বিষয়ে তার গণতন্ত্রপন্থী বক্তব্যকে সংযত করার আহ্বান জানান। তাদের যুক্তি ছিল, যদি বিরোধীরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তবে এটা বাংলাদেশকে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে পারে। আর এতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

শেখ হাসিনা
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, “আপনি গণতন্ত্রের কথা মাথায় রেখে চিন্তাভাবনা করছেন, কিন্তু আমাদের জন্য সমস্যাগুলো অনেক অনেক বেশি গুরুতর। মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনেক কথোপকথন হয়েছিল যেখানে আমরা বলেছিলাম, এটা আমাদের জন্য একটি মূল উদ্বেগের বিষয়। আপনি আমাদের ততক্ষণ পর্যন্ত কৌশলগত অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন না, যতক্ষণ না আমরা কোনো কৌশলগত বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাই।”

শেষ পর্যন্ত, বাইডেন প্রশাসন সমালোচনার সুর অনেকটাই নরম করে ও হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞার হুমকি স্থগিত করে। কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশের অনেককেই হতাশ করেছে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সার্বিক পরিস্থিত বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে ভারতীয় চাপের খুব একটা সম্পর্ক নেই।

সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিক্ষোভকারীরা সেনাবাহিনীর কারফিউ অমান্য করে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের দিকে যাওয়া শুরু করলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। এই নিয়ে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন উভয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তারা বাংলাদেশকে ভুলভাবে ব্যবহার করেছে কি না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, “বাংলাদেশ নিয়ে সব সময় একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে হয়। কারণ এমন অনেক জায়গা আছে যেখানের পরিস্থিতি জটিল। সেখানে  হয়তো আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে এমনভাবে কাজ করতে হয় যা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”

বাংলাদেশ পরিচালনা নিয়ে বিভেদ

গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে কীভাবে পরিচালনা করা যায় সেটা নিয়ে মার্কিন সরকারের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তাসহ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কেউ কেউ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, বিশেষ করে যেহেতু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার নিয়ে মার্কিন বিদেশি নীতির  প্রচার চালিয়েছিলেন। যদিও হাস এই নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনাকে আরও চাপে ফেললে পিটার হাসসহ মার্কিন কূটনীতিকরা নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন।

এমতাবস্থায় হোয়াইট হাউসের কিছু কর্মকর্তা ভারতবিরোধিতার নেতিবাচক দিকটি বিবেচনা করেছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রশমনের বিষয়ে আবেদন করেছিলেন। এমনকি প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন গত নভেম্বরে নয়াদিল্লিতে আসার সময়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও ওয়াশিংটন সফরকালীন বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদি
ছবি: সংগৃহীত

একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, “বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদাই ছিল আমাদের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা অনেক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে সেগুলো সম্পর্কে কথা বলেছি- তবে এটা বাস্তব ঘটনা যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ছিল এবং সেখানে অনেকগুলো বিষয়ে আমাদের ও অন্যান্য দেশের স্বার্থ জড়িয়ে ছিল। আমাদের সেখানকার প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্তির জন্য গঠনমূলক একটি উপায় খুঁজে বের করার  দরকার ছিল যেমন আমরা সব জায়গায় করি। তাই আমাদের নীতি ছিল এই দুটি জিনিসের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।”

শেখ হাসিনা

একতরফা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দাবি করেন শেখ হাসিনা

গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে শেখ হাসিনা তার অনেক প্রতিপক্ষকে জেলে বা আত্মগোপনে রেখে একতরফা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দাবি করেন। এই নির্বাচনী ফলাফলকে সমর্থন করেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। এতে বাংলাদেশের বিরোধীরা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেন। গত বছর ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দেশ মালদ্বীপেও চীনপন্থী মোহাম্মদ মুইজু ইন্ডিয়া আউট  প্রচারণা চালিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। এছাড়াও শ্রীলঙ্কায় এই বছর ভারতবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। কারণ নরেন্দ্র মোদির দাবি, তার  বিরোধীরা ভারতের ন্যায্য অঞ্চল শ্রীলঙ্কাকে সস্তায় দিয়ে দিয়েছে।

ঢাকায় ডেপুটি চিফ অব মিশনের দায়িত্ব পালন করা সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিজ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করেছে। বিশেষত বাংলাদেশের ঘটনায় এটি অনেক স্পষ্ট।”

শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কৌশল পরিবর্তন করেছেন। তারা বাংলাদেশে যে ক্ষমতায় আসবে তার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। গত সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তার শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন। যদিও শেখ হাসিনাকে সমর্থনের জন্য ভারতের সমালোচনা করেছিলেন ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্র ইউনূসকে সমর্থন করেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের বিরোধীদের নিয়ে  তাদের অস্বস্তির কারণ আছে। ২০০০ সালের মধ্যভাগে শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাসনামলে, ইসলামী জঙ্গিরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আক্রমণের জন্য অস্ত্র পাচার করেছিল ও পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ভারতীয় ও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, বিএনপি শাসনের এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ভারত কেন শেখ হাসিনাকে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে এতটা অনড় ছিল।

ভারতীয় কর্মকর্তারা এখন সতর্ক করেছেন যে, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতাসীন হতে পারে। ভারতীয় মিডিয়া শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনার নিয়ে প্রতিবেদন করছে। বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি আশ্বস্ত করছে যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের হিন্দুরা নিরাপদে থাকবে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাদের বলার চেষ্টা করেছি যে, আপনার সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না। ভারতের উদ্বেগ যাই হোক না কেন আমরা সেটা প্রশমনের চেষ্টা করেছি। অতীতকে বহন করা উভয়পক্ষের ক্ষেত্রেই বোকামি হবে।”

শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই অভিযোগ ওঠে, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান মিলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ভারতের সাবেক একজন জ্যেষ্ঠ জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “তাত্ত্বিকভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করা অর্থপূর্ণ, কিন্তু নয়াদিল্লি বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেনি। ঢাকা থেকে আসা সবাই একই প্রতিক্রিয়া জানাতো, বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী অনুভূতি একটি নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবুও আমরা মনে করতাম, দেশের প্রশাসনিক ও সামরিক বাহিনীর ওপর তার (শেখ হাসিনা) সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম সরকারকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে, তাই তিনি আবারও দেশ পরিচালনা করবেন। প্রকৃত কথা হলো, পুরো বাসায় আগুন লাগানোর জন্য শুধু একটা স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন ছিল।”

Link copied!