আগস্ট ৭, ২০২৪, ০৮:২৫ পিএম
গত ৫ আগস্ট বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরে পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা স্বৈরতন্ত্র থেকে রক্ষা করে বলেও অভিমত দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশ হওয়া নিজের একটি নিবন্ধে এই মন্তব্য করেন তিনি। এই লেখায় রাজনৈতিক সব বন্দীর মুক্তি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
ড. ইউনূস জানান, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ অনেক ইতিবাচক অর্জনের জন্য পরিচিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দারিদ্র্যের হার হ্রাস, ক্ষুদ্র ঋণ প্রবর্তন, সামাজিক উদ্যোগ ও ব্যবসার ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার মতো বিষয় রয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের অনন্য ধারণার প্রবর্তনকেও গত ৩ দশকে বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করেন নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ।
আরও পড়ুন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ বৃহস্পতিবার রাত আটটায়: সেনা প্রধান
দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশ হওয়া নিজের লেখা তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্যের কথাও আলাদা করে উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানান, তৈরি পোশাক শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পোশাক বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং এতে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
নিবন্ধে ড. ইউনূস বলেন, তবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এসব অর্জন থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র ক্ষয় হতে হতে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে- এমন দেশ হিসেবেও আমরা পরিচিত। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন এতটাই বিতর্কিত ছিল যে তা ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।
এই অর্থনীতিবিদ যোগ করেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে ৩০ বছরের কম বয়সের কোনও বাংলাদেশি এখনও ‘কারচুপি হয়নি’ এমন নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এ ছাড়া তার ভাষ্য, শেখ হাসিনার সরকার এদেশের বিভিন্ন সংস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছে। যার মধ্যে বিচার বিভাগ ও শিক্ষা ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ড. ইউনূস জানান, এসব ঘটনার ফলে সব খাতের মেধাবীরা ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছেন। যারা থেকে গেছেন, তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প ছিল হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানানো অথবা নির্যাতনের শিকার হওয়া।
তিনি যোগ করেন, “আমি নিজে দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেই এবং গত সপ্তাহের তথ্য অনুযায়ী আদালতে আমার বিরুদ্ধে ১৯০টি মামলা চলছিল। আমার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা চলছে। বিচারে দোষী প্রমাণ হলে যার সর্বোচ্চ দণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আমার বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে।”
আরও পড়ুন: গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাবেন ইউনূস: সেনা প্রধান
নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ জানান, সম্প্রতি আদালত ও আইনি লড়াইয়ের পেছনে তিনি যত বেশি সময় দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক কম সময় দিতে পেরেছেন তার ভালোবাসার বিষয়গুলোতে। উদাহরণ হিসেবে তিনি সামাজিক ব্যবসার কথা জানান, যার মাধ্যমে বাজারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমসহ আরও অসংখ্য মানুষের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “শুধু আমিই এ ধরনের হয়রানির মধ্য দিয়ে গেছি, ব্যাপারটা এমন নয়।”
ড. ইউনূস জানান, গত এক মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ বাংলাদেশকে এই একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছে। শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ শুরু হলেও দ্রুতই এটা সারা দেশের মানুষের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়। অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ সব মানুষের কাছে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় খালাস পেলেন ইউনূসসহ শীর্ষ ৩ কর্মকর্তা
দ্য ইকোনোমিস্টের নিবন্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখ করেন, “গত ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণ হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ও নিরীহ জনগণসহ মোট ৩০০ জনের প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশের পাশাপাশি দেশের প্রায় সব নাগরিকদের মতো আমিও এই সংবাদে আনন্দিত হই। এখন আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা না যায়। বরং এতে যেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সাম্যবাদের সোনালি যুগের সূচনা হয়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের পরবর্তী উদ্যোগ হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং কয়েক মাসের মধ্যে একটি মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন। আমি এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে আগ্রহী এবং আমি আশা করব অন্যরাও আমার পাশে থাকবেন। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে নতুন রাজনীতিবিদ প্রয়োজন। তরুণদের মধ্যে থেকে নতুন নেতৃত্ব আসতে হবে। সর্বোপরি আমাদের এমন তরুণ নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা প্রতিশোধপরায়ণ নন। আমাদের আগের সরকারগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে এই প্রবণতা দেখেছি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর এবারের এই দ্বিতীয় বিপ্লবের সম্মুখে যেসব ছাত্রনেতারা ছিলেন, তাদের উচিত সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া।”
সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের শুভকামনা ও তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “আমি তাদেরকে ৩ শূন্যের পৃথিবী গড়তে উৎসাহ দেবো- শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ ও শূন্য বেকারত্ব।”
‘অন্ধকার যুগেও’ গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জোগানো ব্যক্তি-সংগঠনকে কৃতজ্ঞতা
শেখ হাসিনা সরকারের ‘অন্ধকার যুগেও’ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন সমর্থন তৈরি করেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। একই সময় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ক্লুনি ফেডারেশন ফর জাস্টিসের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ যোগ করেন, সারা বিশ্বের মানুষ আমাদের জনগণের ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সরব ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা দেশের বাইরে থেকে তাদের মাতৃভূমিতে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে গেছে।
ড. ইউনূস আশা করেন, বাংলাদেশি প্রবাসী বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে আমাদের গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ও অর্থনীতি বিনির্মাণে সহায়তা করবেন।
নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের মতো কয়েকটি দেশ সদ্য-উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, এ ধরনের ক্ষত সারিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব পুনর্গঠনের সুযোগ রয়েছে।
নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ আরও আশা করেন, বাংলাদেশের এই নতুন স্বাধীনতায় আঞ্চলিক জোট সার্কের পুনর্জাগরণের পথ তৈরি হবে এবং এটি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বলিষ্ঠ সংগঠনে পরিণত হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি পেছনের দিকে হেঁটেছে: ইউনূস
দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি পেছনের দিকে হেঁটেছে বলেও মন্তব্য করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, “আসুন ৫ আগস্ট পাওয়া দ্বিতীয় স্বাধীনতার হাত ধরে আজ থেকেই আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। যারা গুরুত্বপূর্ণ এই নতুন বিজয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকেই নতুন প্রজন্মের একদল নেতা উঠে আসুক। যাদের আত্মত্যাগে আমরা এই নতুন সুযোগ পেয়েছি, তাদের সেই আত্মত্যাগ তখনই সফল হবে যখন দেশের উন্নতির জন্য নতুন নেতৃত্বের প্রাণশক্তি ও দূরদৃষ্টির উপযুক্ত ব্যবহার করা যাবে। এটা এমন এক সুযোগ, যা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।”