'চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়/আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা/আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ/শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস.../ বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা/তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর/তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে/নেমে গেছে/শুকনো রক্তের রেখা...।' কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'চে গুয়েভারার প্রতি' এই কবিতায় সশ্রদ্ধ উচ্চারণের মতো সারা বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের চে'র স্মরণে মাথা নত হয়ে আসে।
তার পুরো নাম আর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা। তবে, শুধু ‘চে’ নামেই তাকে চেনে সারা দুনিয়া। আর্জেন্টিনায় জন্ম নেওয়া এই বিপ্লবী মাত্র ১১ বছর বয়সে এক বিচিত্র কারণে কিউবার প্রতি অনুরক্ত হন। কিউবার দাবা খেলোয়াড় কাপাব্লাংকা এসেছিলেন বুয়েনস এইরেসে। চে ছিলেন দাবার দারুণ ভক্ত। কাপাব্লাংকার আগমন তাকে কিউবা সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছিল। এছাড়া রাগবী ও ফুটবল খেলারও দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি।
হাঁপানি ছিল চে গুয়েভারার নিত্যসঙ্গী। সারা জীবন তিনি এই রোগ বয়ে বেড়িয়েছেন। এই রোগের কারণে প্রথম দুই বছর স্কুলে যেতে পারেননি, পড়াশোনা করেছেন বাড়িতে বসে। দাবা খেলার প্রতি প্রেম আরও গাঢ় হয় এসময়ই।
সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা চে'র পরিবারে ছিল তিন হাজারেরও বেশি বই। যা চে-কে করে তোলে সমাজসচেতন। সে সময় তিনি কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির বইয়ের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, আলবার্ট ক্যামাস, ভ্লাদিমির লেনিন, রবার্ট ফ্রস্টের বইও পড়েছেন।
কবিতা পছন্দ করতেন তিনি। নিজেও লিখতেন কবিতা। বিজ্ঞানের প্রতি দারুণ আকর্ষণ ছিল তার। বিশেষ করে গণিত ছিল তার প্রিয় বিষয়গুলোর অন্যতম। কিন্তু পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানকে।
প্রাচীন সভ্যতার প্রতি আকর্ষণ ছিল এর্নেস্তো চে গুয়েভারার। সুযোগ পেলেই রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে চলে যেতেন।
১৯৪৮ সালে বুয়েনস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিভাগে পড়শুনা শুরু করেন৷ এ সময়ই ভ্রমণের বাসনা জাগে তার মনে ৷ ১৯৫০ সালে একটি সাধারণ সাইকেলে ছোট একটি ইঞ্জিন সংস্থাপন করে বেড়িয়ে পড়েন চে গুয়েভারা৷ বহু মাস ধরে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেন তিনি৷ আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে ল্যাটিন অ্যামেরিকার বহু প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়ান চে৷ এই ভ্রমণকালেই তার নজরে পড়েছে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত মানুষের জীবন৷ আর সেই থেকেই ধীরে ধীরে বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয় তার মনে ৷ এই ভ্রমণের পর আর্জেন্টিনায় ফিরে এসে ডাক্তারি শেষ করেন চে এবং পরবর্তী সময়ে মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন৷
পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের 'ছাব্বিশে জুলাই' আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। খুব অল্পদিনেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন করেন।
এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান। এর ফলে এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালাস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সফল বিপ্লবের পর চে বলিভিয়ায় গিয়েছিলেন আরেকটি বিপ্লবের প্রত্যয় নিয়ে। বলিভিয়ায় থাকার সময় তিনি সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার শহর লা হিগুয়েরাতে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যদণ্ড কার্যকর করে।
তাকে হত্যা করার পরও দশকের পর দশকজুড়ে চে হয়ে রয়েছেন তারুণ্যের প্রতীক। যে তরুণ স্বপ্ন দেখে, যে তরুণ সবার জন্য সমান একটি পৃথিবীকে আলিঙ্গন করতে চায়, তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন চে। মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন বিপ্লবের মুখচ্ছবি হিসেবে বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়েছে।
অনেকেই বলেন, চে গুয়েভারার নাম শুনলেই চোখে ভাসে একজন রোমান্টিক-বিপ্লবীর। নিজের রোমান্টিকতা সম্পর্কে চে বলেছেন, ‘অনেকেই আমাকে রোমাঞ্চপিয়াসী বলে ভাবেন। হ্যাঁ, আমি রোমাঞ্চপিয়াসী, তবে অন্য ধরনের। আমি সেই ধরনের রোমাঞ্চপিয়াসী, যে সত্যকে প্রমাণ করার জন্য নিজের জীবনকে বাজি রাখে।’
চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তার নাম প্রকাশিত হয়।
গেরিলা যোদ্ধার পোশাকে ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ ‘গেরিলেরো হেরোইকো নামে’ আলবের্তো কোর্দার তোলা চে’র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।