ফেসবুক এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে দাঁড়ালে নিমেষেই পৃথিবীর সবখানে পৌঁছে যাওয়া যায়। মাইক লাগিয়ে বক্তব্য দিয়ে যত শ্রোতার কাছে যাওয়া যায়, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দর্শক-শ্রোতা মেলে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রচার মাধ্যমে হিসেবে এর ক্ষমতা ভালোই বুঝতে পেরেছেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী, তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা। বহু প্রার্থী ফেসবুকে বক্তব্য রাখছেন। রাজনীতি নিয়ে গরমাগরম বিতর্কে মাতছেন নেটিজেনরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) হিসাবে দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। তাদের অর্ধেকেরও বেশি লোক ভোটার । এই বিপুল সংখ্যক ভোটারের কাছে রাজনৈতিক দলগুলো বক্তব্য তুলে ধরছে, বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকলেও দেশে প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক।
ঢাকায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই কোটি। ফলে প্রার্থীদের অনেকেই বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছাতে ফেসবুক পেজে পোস্ট দিচ্ছেন বা বুস্টও করছেন। এতে জনসভা, পথসভা করার চেয়ে কম খরচ হচ্ছে, কিন্তু বার্তা পৌঁছাচ্ছে বেশি মানুষের কাছে। এ দিক থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালানো বেশ ইতিবাচক। কিন্তু এই মাধ্যম নিয়ে গভীর উদ্বেগের বিষয়ও রয়েছে। নানা ধরনের গুজব ও ভুয়া খবর ছড়িয়ে অনেকে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া খুবই কঠিন।
এদিকে বেসরকারি সংস্থা ‘ডিজিটালি রাইট’-এর গবেষণায় ত্রুটিপূর্ণভাবে বিজ্ঞাপন শনাক্ত করছে মেটার প্রতিষ্ঠান ফেসবুক। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনকে সাধারণ বিজ্ঞাপন হিসেবে চিহ্নিত করছে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি। প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি ও অর্থের উৎস সম্পর্কে অস্বচ্ছতা থাকা সত্ত্বেও অনেক বিজ্ঞাপন সম্প্রচার ও সংরক্ষণ করছে এ তথ্য উঠে এসেছে।
যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে তখনই ‘হিটস অ্যান্ড মিসেস: অ্যান এক্সামিনেশন অব মেটাস পলিটিক্যাল অ্যাড পলিসি এনফোর্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, মেটার বিজ্ঞাপন শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে ত্রুটির কারণে অরাজনৈতিক বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে, যা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করছে। পণ্যের প্রচার থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান বিষয়ক বিজ্ঞাপনও ভুলভাবে চিহ্নিত হচ্ছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ত্রুটি মেটার বিজ্ঞাপন শ্রেণিবিন্যাস অ্যালগরিদমের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ফেসবুক নিজেই যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে, চিহ্নিত অনেক বিজ্ঞাপনে সেসবের ঘাটতি দেখা গেছে গবেষণায়। মেটার শনাক্তকরণ পদ্ধতির ত্রুটির কারণে বিজ্ঞাপনগুলোতে অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট তথ্য সরবরাহের সুযোগ পেয়েছেন বিজ্ঞাপনদাতারা। তথ্যের ঘাটতির কারণে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের অর্থের উৎস সম্পর্কে অন্ধকারে থাকছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন পণ্য বা সেবার প্রচারণায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এটি রাজনীতিকদের অল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে সহায়তা করছে। নির্বাচনের আগে ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে যোগাযোগের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে এমন বিজ্ঞাপন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের উপলব্ধি গঠনে ভূমিকা রাখছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তাই এসব বিজ্ঞাপন অস্বচ্ছ ও ভুল তথ্য দিলে জনমত ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।
গবেষণায় স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তাসহ ৫০টি বিজ্ঞাপন চিহ্নিত করা হয়, যেগুলোর প্রায় অর্ধেক সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের কাছ থেকে আসে। এদিকে, ফেসবুকে অরাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত বিজ্ঞাপনগুলোর ৯০ শতাংশে রাজনৈতিক দলের নাম বা রাজনীতিবিদের কথা উল্লেখ ছিল। আর ৭২ শতাংশে ছিল রাজনৈতিক নেতা বা দলীয় প্রতীক। বিজ্ঞাপনগুলো গবেষণার সময় ‘কি ওয়ার্ড’ অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, অনেক বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক হিসেবে তখনই চিহ্নিত হয়েছে, যখন তা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পেজে শেয়ার হয়েছে, তার আগে নয়।
মেটার সংরক্ষিত ৩১৪টি বিজ্ঞাপন পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেয়র নির্বাচনের প্রার্থী এবং রাজনীতিবিদসহ ৯ জন ফেসবুকে তাদের বিজ্ঞাপন প্রদর্শনে প্রয়োজনীয় তথ্য দেননি। অথচ মেটার শর্ত অনুসারে, ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দিতে হলে বিজ্ঞাপনদাতার ফোন, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের সঠিক ঠিকানা সরবরাহ করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩১৪টি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ বিজ্ঞাপনদাতা মেটাকে অস্পষ্ট বা অপর্যাপ্ত ঠিকানা দিয়েছেন। ৪৭ শতাংশ শুধু জেলার নাম লিখেছেন। সম্পূর্ণ ও সঠিক ঠিকানা দিয়েছেন মাত্র ১৭ শতাংশ বিজ্ঞাপনদাতা। ৫৮ শতাংশ ওয়েবসাইটের পরিবর্তে ফেসবুক পেজের লিংক সরবরাহ করেছেন।
ডিজিটালি রাইটের প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের বিজ্ঞাপনে ব্যয় করা স্বাভাবিক বিষয়। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তাদের বার্তা বিপুলসংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছাতে এটি বেশ কার্যকর। কিন্তু জনগণকে অবশ্যই জানতে হবে যে, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনগুলোর খরচ কে দিচ্ছেন। এতে তারা সচেতনভাবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এ জন্যই বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা জরুরি। মেটার বিজ্ঞাপন শনাক্তকরণ পদ্ধতির ঘাটতি এখানেই।’
গবেষণায় মেটার বিজ্ঞাপন লাইব্রেরিতে রাজনৈতিক হিসেবে সংরক্ষিত ১ হাজার ৪২০টি বিজ্ঞাপনের নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়, যেগুলো অরাজনৈতিক পেজ বা ব্যক্তি প্রচার করেন। এসব বিজ্ঞাপন ছিল মূলত বাণিজ্যিক, সংবাদ ও মিডিয়াসহ বিভিন্ন খাতের।
গবেষণায় দেখা গেছে, রাজনীতিবিদদের বাণিজ্যিক পেজের বিজ্ঞাপনকেও রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে চিহ্নিত করেছে মেটা। এমনকি রাজনীতিবিদদের কোম্পানির পণ্যের বিজ্ঞাপনও ভুল শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিনিস্টার টেলিভিশন ও রেফ্রিজারেটরের বিজ্ঞাপনকে ফেসবুক রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে শনাক্ত করেছে ‘মিনিস্টার’ শব্দটি থাকার কারণে। অথচ, এটি বাংলাদেশি একটি কোম্পানির নাম।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন শনাক্তের পদ্ধতি আরও নির্ভুল করতে হবে। এ কাজে নির্বাচন কমিশন (ইসি), নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী, গবেষক, সুশীল সমাজ ও অংশীজনের সহযোগিতা নিতে হবে। স্বচ্ছতা বাড়াতে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করতে হবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বলছে, এই মাধ্যমের প্রতি তারা নজর রাখছে, কিন্তু সেটি কতটুকু কার্যকর হবে, তা তর্কসাপেক্ষ। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার নিষিদ্ধ।
ডিজিটালি রাইটের প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার চলছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা কর্মীদের সাথে নিয়ে এলাকায় এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে ভোট চাইছে। সবার সঙ্গে কথা বলছেন। তাতে ভোটাররা জানতে পারছেন, কোন প্রার্থীর সম্পর্কে বলা হচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল জগতে বিজ্ঞাপনদাতার সম্পর্কে যদি সঠিক তথ্য না থাকে, তাহলে মানুষ জানতে পারে না কোন বিজ্ঞাপন কে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার একটি স্বাভাবিক বিষয়। সমস্যা তখনই হয়, যখন বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে কে টাকা দিচ্ছে, সেই ঘোষণায় অস্বচ্ছতা থাকে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দায়িত্ব থাকে প্ল্যাটফর্মের।
রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দিতে ফেসবুকে চার ধরনের তথ্য দিতে হয়। সেখানে ৩১৪টি বিজ্ঞাপনের দাতার ঘোষণা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯টি ক্ষেত্রে কোনো ধরনের তথ্য দেওয়া হয়নি। তবু বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে ফেসবুক। ১০টি ক্ষেত্রে শুধু ফোন নম্বর ও জায়গার, নাম দেওয়া হয়েছে, যা অপর্যাপ্ত রয়েছে। আটটি বিজ্ঞাপনদাতার ওয়েবসাইটের ঠিকানা নেই। দুটিতে ঠিকানা দেওয়া হয়নি। মেটার বিজ্ঞাপন নীতিতে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থদাতার ফোন নম্বর, ই-মেইল, ওয়েবসাইট ও ঠিকানা সঠিক ও কার্যকর হতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি ৩১৪টির মধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ঠিকানা সঠিক ভাবে দেওয়া হয়নি ও প্রয়োজনীয় তথ্য নেই।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে কোনো কোনো অরাজনৈতিক বিজ্ঞাপনকে তারা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনকে অরাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমরা অনেক রাজনীতিবিদদের পেজ থেকে দেখেছি বিজ্ঞাপনগুলো অরাজনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মেটার অ্যালগরিদম এসব বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক হিসেবে শনাক্তে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
ফেসবুকে নির্বাচনী প্রচারণায় বিভ্রান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলেন, কু-তথ্য অপ্রতিরোধ্য, কু-তথ্য চলছে-চলবে, আমরা সাধারণ মানুষেরা কু-তথ্যের বিষয়ে সচেতন হতে পারি, অন্যকে সচেতন করতে পারি। আমাদের দরকার সচেতনতা তৈরি ও মানুষের আচরণগত পরিবর্তন, যাতে ফেসবুকে কিছু দেখলেই মানুষ যেন তা বিশ্বাস না করে। ফেসবুকে যা দেখি তা শেয়ার করার আগে ভাবতে হবে, কিছু বিশ্বাস করার আগে সত্যতা যাচাই করতে হবে।
নির্বাচনী প্রচারণার নিয়ম মেনে ফেসবুকে করলে অসুবিধা নেই বলে মনে করছেন অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ফেসবুকে প্রচারণা করাটা সস্তা, আর সবার কাছে পৌঁছানো সহজ, তবে আমি মনে করি ভোটারদের ৫ বছরে ১ দিন সময় থাকে। জনগণ কিন্তু এমনটা মনে করতেই পারে যে যাকে আমরা দেখলাম না চিনলাম না তাকে আমরা ভোট দিব না। এমন সম্ভাব্যতা মাথায় রেখে ক্ষেত্রে প্রার্থীরা ঠিক করুক তারা কি করবেন? লোকের দ্বারে দ্বারে যাবেন না নাকি ফেসবুকে কাজ সারবেন তা যার-যার বিবেচনা।