ছবি: সংগৃহীত
“লালনকন্যা”, বরেণ্য লোকসংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার চলে যাওয়ায় শুধু সংগীতের একটি অধ্যায় শেষ হয়নি, বরং বাংলার মাটির গানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হারিয়ে গেছে। তার কণ্ঠের প্রতিটি সুরে মিশে ছিল এক গভীর আবেগ, এক পরম শান্তি, যা মানুষকে লালনের দর্শনের কাছাকাছি নিয়ে যেত। আজ যখন তার কণ্ঠ নীরব, তখন আমাদের মনে পড়ে যায় সেই গানগুলো, যা তিনি শুধু গেয়েই যাননি, বরং নিজের জীবনে ধারণ করেছিলেন।
“লালনকন্যা” থেকে বিশ্বমঞ্চের তারকা
ফরিদা পারভীন, যিনি সবার কাছে ‘লালনকন্যা’ নামেই পরিচিত ছিলেন, ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি সংগীতের প্রতি এক গভীর টান অনুভব করেন। মাগুরায় থাকাকালীন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তার সংগীতের হাতেখড়ি হয়। নজরুলসংগীত দিয়ে তার পেশাদার জীবন শুরু হলেও, লালনের গানই তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। তিনি ছিলেন লালন সাঁইয়ের গানের একনিষ্ঠ সাধক ও প্রচারক।
একটি গান যেভাবে বদলে দিয়েছিল জীবন
ফরিদা পারভীনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল একটি মাত্র গান—“সত্য বল সুপথে চল”। ১৯৬৮ সালে নজরুলসংগীত শিল্পী হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কুষ্টিয়ায় এক হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শে এবং বাবার উৎসাহে তিনি লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শেখা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে দোলপূর্ণিমার উৎসবে যখন তিনি প্রথমবারের মতো এই গানটি পরিবেশন করেন, শ্রোতাদের আবেগ ও ভালোবাসা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এটাই তার প্রকৃত পথ। এই একটি গানই তাকে তার জীবনের নতুন দিশা দিয়েছিল। এরপর তিনি ধীরে ধীরে লালনের গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনকে বুঝতে শুরু করেন, এবং লালনের গানকে নিজের জীবনের অংশ করে নেন।
কর্মময় জীবন ও অবদান
ফরিদা পারভীনের ৫৫ বছরের সংগীতজীবন ছিল গৌরবময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। তিনি শুধু বাংলাদেশেই নয়, জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লালনসংগীতের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার গানের এমন এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল যে, তা ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। সুইডেন সফরের সময় তার গান শুনে সেখানকার রানি অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেছিলেন, “আমি কথাগুলো বুঝি না, কিন্তু তার কণ্ঠে যে বেদনা আছে, তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।”
তার অবদানের মধ্যে অন্যতম হলো ‘ফরিদা পারভীন ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা, যার মাধ্যমে তিনি লালনের গান সংরক্ষণ, স্বরলিপি তৈরি এবং বাদ্যযন্ত্রের আর্কাইভ গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। লালনসংগীতের প্রতি তার এই অপরিসীম অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮৭ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়াও, তিনি ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ ছবিতে ‘নিন্দার কাঁটা’ গানের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ এবং ২০০৮ সালে জাপানের ‘ফুকুওয়াকা পুরস্কার’ লাভ করেন। লালনসংগীতের পাশাপাশি তার গাওয়া দেশাত্মবোধক গান, যেমন—“তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম” এবং “এই পদ্মা এই মেঘনা” আজও জনপ্রিয়।
শেষ জীবনের লড়াই ও প্রয়াণ
ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। শেষ জীবনে তাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হতো। গত ২ সেপ্টেম্বর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে অবশেষে গত শনিবার (নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে) রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে শুধু তার পরিবার বা ভক্তরাই নয়, পুরো জাতি এক অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে। তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও, তার সুর, তার দর্শন এবং তার কর্ম অমর হয়ে থাকবে।
ফরিদা পারভীন—এক জীবনের নাম, এক গানের নাম।