নামে কাঙ্গালিনী,কন্ঠে তাঁর প্রকৃতির ঐশ্বর্য

তুহিন কান্তি দাস

মার্চ ২৪, ২০২১, ১২:৫৮ এএম

নামে কাঙ্গালিনী,কন্ঠে তাঁর প্রকৃতির ঐশ্বর্য

হাইকোর্ট মাজারের সামনে শিল্পী কানাইলাল শীলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন এক বাউল। কবি আসাদ চৌধুরী অনুষ্ঠান শেষে বাংলা একাডেমিতে দেখা করতে বলেন সেই বাউলকে। এভাবেই বাংলা লোকসংগীতের কালজয়ী ফেরিওয়ালা কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে আবিষ্কার করেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী।

সেসময় আসাদ চৌধুরী বাংলা একাডেমিতে কর্মরত পাশাপাশি বিটিভিতে "প্রচ্ছদ" নামে একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করতেন। সেই সুবাদে কাঙ্গালিনী সুফিয়ার কন্ঠসুধায় সবাইকে মোহ করতে অনুষ্ঠানগুলোতে সুযোগ করে দেন তিনি। তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তিনি কোরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া বাংলাদেশ দলের প্রধান হিসেবে সহকর্মীদের অনুরোধ করেন গ্রাম বাংলার প্রতীভাবান কোন শিল্পীর সন্ধান করতে। সহকর্মীরা তার কাছে নিয়ে আসেন সুফিয়াকে। সুফিয়ার অপূর্ব গায়কী, ভাব-আবেগ মুগ্ধ করলো মুস্তাফা মনোয়ারকে। সুফিয়াকে গান গাইতে কোরিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু সুফিয়া তখন ছিলেন আর্থিকভাবে নাজেহাল। তার এই করুণ চিত্র দেখেই মুস্তাফা মনোয়ার তার নাম দিয়েছিলেন সুফিয়া কাঙ্গালিনী।

সুফিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী বর্তমান রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে ১৯৫৫/৫৬ সালে তার জন্ম, তবে পাসপোর্টে তার জন্মসাল লেখা ১৯৬২। তার মা কমলা ও বাবা খোকন হালদার।দুই বোন ও এক ভাইয়ের পরে জন্ম নেয়া সুফিয়া জেলে পরিবারে অভাব অনটনে বড় হয়েছেন। সুফিয়ার আসল নাম ছিল অনিতা হালদার বা টুনি হালদার, এবং ডাকনাম বুচি।

ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি সহজাত প্রবৃত্তির দরুণ সবসময় গুণ গুণ করে গাইতেন পল্লীগান। একবার শুনেই কোন গান মনে রাখতে পারতেন অবিকল। ভাগ্যের ফেরে বারো-তেরো বছর বয়সে সুধীর হালদারের সাথে তার বিয়ে হয়।

দর্শন সুধীর হালদার পাতলা গড়নার শ্যামলা অনিতাকে অপছন্দ করতেন। ফলে প্রায় সময়ই স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন। পাঁচ মাসের গর্ভবতী অনিতাকে একবার অজ্ঞান অবস্থায় স্বামী বস্তাবন্দি করে ফেলে দেন কুমোর নদীতে।

সেখান থেকে খোলা চুল দেখে মাছ ধরতে আসা জেলেরা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে মা-বাবা এসে স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে যায় মেয়েকে। এর পর আর স্বামীর বাড়ি যাওয়া হয়নি। নির্যাতন মামলায় স্বামী কয়েকমাস কারাবাসের পর স্ত্রী-কন্যার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়ার শর্তে সমঝোতা হয় কিন্তু সমস্যার সমাধান মেলে না। ফলে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি পালিয়ে যান । এমতাবস্থায় মেয়ে পুষ্পকে রেখে মায়-বাবার সহযোগিতায় আশ্রয় নেন বৈষ্ণব আখড়ায়।

https://www.youtube.com/watch?v=P6LjXHZz9FE
 

অনিতা বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে প্রায় পাঁচ বছর সোনাপুর আশ্রমে কাটান। সেখানেই তার সাথে দেখা হয় দেবেন ক্ষ্যাপা এবং গৌর মোহন্তের সাথে। তাদেরকে গুরু মেনে বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পাঠ নেন। এই আখড়াতে অনিতা হালদার হয়ে যায় অনিতা ক্ষ্যাপী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি সেনারা বৈষ্ণব আখড়াতে হামলা চালালে দেশত্যাগ করে আশ্রয় নেন ভারতের পশিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা এবং সীমান্তবর্তী লালগোলায়। সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তিনি গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ দিতেন, প্রেরণা যোগাতেন। শেখানে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা মান্দার ফকিরের সাথে। দেশ স্বাধীন হলে অনিতা ক্ষ্যাপী মান্দার ফকিরের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চলে যান। সেখানে গিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজ নাম রাখেন সুফিয়া খাতুন।

গানের জগতে বিচরণের জন্যে সুফিয়া ভাঙ্গার থেকে আবার চলে আসেন তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত বর্তমান সিরাজগঞ্জ সদরে। এই সময়ে তিনি পালাগানের নতুন জগৎ গড়ে তোলেন। পাল্লা দিয়ে গান গাইতে গাইতে তিনি বাউল সুফিয়া হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন।

সমসাময়িক শিল্পীদের পরামর্শে মেয়ে পুষ্পকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের দিকে ঢাকা চলে আসেন সুফিয়া। তিনি ঢাকার বাড্ডায় শাহাজাদপুরে এসে ওঠেন। হাইকোর্টের মাজারের মজমায় গান গাইতেন নিয়মিত। বিভিন্ন মজমায় লালন এবং বাউল গান গেয়ে সংসার চালাতেন। সেই মজমা থেকেই আস্তে আস্তে তিনি হয়ে ওঠেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া।

বাউল শিল্পী হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাত সুফিয়া আজো সেই পরানের বান্ধবকে খুঁজে ফেরেন। দেশী-বিদেশী অসংখ্য পুরষ্কার জেতা সুফিয়া এখনো সাভারের জামসিঙে সেই হালদার পরিবারে অভাব অনটন মাথায় নিয়েই জীবন চালাচ্ছেন। তাইতো তাঁর মেয়ে পুষ্পের কন্ঠে আজো সেই আক্ষেপের সুর ,"একজন নামি-দামি শিল্পী এখন না খেয়ে মরে, মানুষতো ভাবে কোটি টাকার মালিক।"

কাঙ্গালিনী সুফিয়ার জীবন ও গান বইয়ের লেখক এবং বাংলা একাডেমির ফোকলোর উপবিভাগের উপপরিচালক ড.আমিনুর রহমান সুলতান বলেন, "সুফিয়া মূলত বাউল এবং বৈষ্ণব ধারার সমন্বয়ে প্রকৃতির ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত একজন শিল্পী। আর্থিকভাবে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অনেক শিল্পীকে মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে জীবিত অবস্থাতেই তাকে এই সম্মাননা দেয়া যায় কিনা ভাবা যেতে পারে, যেন তিনি নিজেই দেখে যেতে পারেন।"

Link copied!