মার্চ ২৮, ২০২৪, ০৮:২১ পিএম
বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল ম্যাচ রেফারি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয়া রানী দাস। গত ২৩ মার্চ এক বার্তায় বিষয়টি জানিয়েছে আইসিসি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও কীভাবে আইসিসির রেফারি হলেন, কেমন ছিল তার এই দীর্ঘ পথচলা এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সঙ্গে।
প্রশ্ন: আপনি আইসিসির ম্যাচ রেফারি হলেন, কেমন লাগছে?
সুপ্রিয়া রানী দাস: খুব ভালো লাগছে, এই অনুভূতি অসাধারণ। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা আমার প্রতি।
প্রশ্ন: আপনার খেলাধুলার শুরু কবে থেকে, কোন পর্যায়ে খেলেছেন?
সুপ্রিয়া রানী দাস: আমার খেলাধুলার শুরু আমার গ্রামের বাড়িতে। আমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া ইউনিয়নে। আমার বাবা-কাকারা খেলাধুলার প্রতি বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখছি তারা রেডিওতে খেলা শুনতেন। আমার দুই ভাই, আমরা ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলাধুলা করে বেড়ে উঠেছি। আমি মোগরাপাড়া এইচ. জি. জি. এস. স্মৃতি সরকারি বিদ্যায়তনের ছাত্রী ছিলাম। স্কুল পর্যায়ে শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমার প্রতিযোগিতামূলক খেলা শুরু। আমি ২০০২ সালে স্কুল ব্যাডমিন্টনে সোনারগাঁ থানা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ঢাকায় বদরুন্নেসা কলেজে পড়াকালীন ২০০৩ সালে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি সার্বিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমার খেলাধুলার সুযোগ আরও প্রসারিত হয়। আমি চারবার রোকেয়া হল বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, দুইবারের রানার্স-আপ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল ও ভলিবল দলের একসময়ের অধিনায়কও ছিলাম। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল ও হ্যান্ডবলে আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আসলে খেলাধুলা সম্ভবত আমার রক্তে। আমার বাবা একসময়ে সোনারগাঁয়ের বিখ্যাত ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন।
প্রশ্ন: ক্রিকেটের সাথে কীভাবে যুক্ত হলেন?
সুপ্রিয়া রানী দাস: দেশে মেয়েদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ২০০৭ সাল থেকে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সেবার আমার ভোলা জেলার হয়ে খেলার সুযোগ হয় এবং আমাদের দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়। মূলত এর পরেই আমি আবাহনীতে খেলার সুযোগ পাই। আমি ডানহাতি মিডিয়াম পেসার ছিলাম। বিভিন্ন সময়ে আমি মৌলভীবাজার জেলা, ঢাকা বিভাগ, সিলেট বিভাগ, দীপালি যুব সংঘ ও আবাহনী দলে খেলেছি। আমার পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটে যুক্ত থাকার নেপথ্যে আবাহনী ক্লাব, মৌলভীবাজার জেলা ও সিলেট বিভাগের একসময়ের অধিনায়ক ফারজানা রহমানের অবদান অসীম। তিনি আমাকে একদম স্বাধীনভাবে খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন সবসময়।
প্রশ্ন: কখনও কি জাতীয় দলের খেলোয়াড় হওয়ার ইচ্ছে ছিল?
সুপ্রিয়া রানী দাস: ২০১১ সালে ট্রাইনেশন কাপের জন্য ঘোষিত জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেবারই আমার স্নাতক সম্মান চূড়ান্ত পরীক্ষায় আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনায় ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য আমি জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্পে যোগ দিইনি। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি! আমি স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হই। ২০১৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদানের পর আমি আসলে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। শিক্ষকতার পাশাপাশি ফিটনেস ঠিক রেখে ঢাকায় গিয়ে নিয়মিত খেলাধুলা করা তখন সম্ভব ছিল না।
প্রশ্ন: অ্যাম্পিয়ার ক্যারিয়ার কবে থেকে শুরু করলেন?
সুপ্রিয়া রানী দাস: ২০১১ সালে আমি বিসিবি আয়োজিত আম্পায়ারিং কোয়ালিফাইং পরীক্ষায় আমার ব্যাচে প্রথম হয়ে পাশ করি। ২০২২ সালে বাংলাদেশে নারী আম্পায়ারিং শুরু হলে আমার কর্মক্ষেত্রের অনুমোদন নিয়ে আমি তাতে সম্পৃক্ত হই। বিসিবি, বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটি, আম্পায়ার অফিস, আম্পায়ার কোচ ও এডুকেটর এবং সহকর্মী ম্যাচ রেফারি-আম্পায়ার-স্কোরারবৃন্দ বিভিন্নভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। প্রায় পঁচিশটি বিভিন্ন পর্যায়ের ম্যাচে আম্পায়ারিং করার পর মূলত আমাদের এডুকেটর অভি ভাইয়ের পরামর্শে আমি ২০২৩-২৪ সিজনে ঢাকা সেকেন্ড ডিভিশন প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচ রেফারি হিসেবে কাজ করা শুরু করি। সর্বশেষ ওয়াইসিএলের চারটি ম্যাচে আমি ম্যাচ রেফারি ছিলাম। এই কাজটি আমি খুবই উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: আপনার এই জায়গায় আসতে বিশেষ কেউ অনুপ্রেরণা ছিল?
সুপ্রিয়া রানী দাস: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মহোদয়, প্রশাসন, আমার বিভাগের মাননীয় সভাপতি মহোদয়, আমার সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ, আমার আত্মীয়-প্রতিবেশী-বন্ধুমহল আমাকে সবসময় সহযোগিতা দিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন, করেন। পরিবার সবসময় আমাকে সহযোগিতা করেছে। আমার স্বামী এবং শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আমাকে অসম্ভব সহযোগিতা দিয়েছেন। নয়তো পিএইচডি’র পড়াশোনার পাশাপাশি আমি এই কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পারতাম না। আমার গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক আমাকে নিরন্তর উৎসাহিত করেন। আমি সবার নিকট কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: শিক্ষকতা এবং অ্যাম্পিয়ারিং একসাথে কীভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন?
সুপ্রিয়া রানী দাস: আমি আসলে যখন যে কাজটি করেছি সেটি সর্বোচ্চ মনোযোগ আর শ্রম দিয়ে আনন্দের সঙ্গে করতে চেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, কাজের সঙ্গে আনন্দের যোগ থাকলে সে কাজ এমনিই সুন্দর হয়! আর সর্বাত্মক চেষ্টায় অনেক প্রতিকূলতাকেও জয় করা যায়। আমার কর্মক্ষেত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে অসাধারণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। ছুটির সময়ে এবং বিশ্বিবদ্যলয়ের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ছুটি নিয়ে আমি খেলা পরিচালনা করে থাকি। এই অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তর থেকে যে অবিস্মরণীয় সমর্থন আমি পেয়েছি তা আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমার নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।