শিক্ষা আছে, শিক্ষিত আছে, নেই শুধু শিক্ষার আলো

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ৩০, ২০২২, ১১:৫১ পিএম

শিক্ষা আছে, শিক্ষিত আছে, নেই শুধু শিক্ষার আলো

গত কয়েকদিনে শিক্ষক লাঞ্ছনার কয়েকটি ঘটনা ঘটতে দেখা গেল দেশে। শুধু তাই নয়, এরইমধ্যে এক ছাত্র তো পিটিয়ে এক শিক্ষকের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে! শিক্ষককে পরীক্ষার হলে কোপানো, শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করানো, শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা দিয়ে জেল খাটানো, শিক্ষককে পুকুরে চুবানো— এরকম বহু ঘটনা সদ্য অতীতে আমরা দেশে ঘটতে দেখেছি। এটি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

শিক্ষকের মর্যাদা বা এ সংক্রান্ত আলোচনা উঠলে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের বিখ্যাত সেই ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটির কথা আলোচনায় চলে আসে। সেই কবিতায় বাদশাহ আলমগীরের ছেলে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন, এ কথা শুনে বাদশাহ ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন এই কারণে যে, তাঁর পুত্র শুধু কেন পানি ঢেলেছিলো, কেন সে হাত দিয়ে শিক্ষকের পা দুখানা ভালো ক’রে ঘঁষে দেয়নি। সেই দিন গত হয়ে গেছে বহুকাল আগেই। এখন ছাত্রেরা শিক্ষকের পুরো শরীরই ধুয়ে দিচ্ছে। পাঁজাকোলো করে পুকুরেও ফেলে দিচ্ছে! আদর্শবাদী হওয়ার কথা বললে ছাত্রেরা শিক্ষককে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরেও ফেলছে। অথচ অনেক শিক্ষক ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার মর্মবাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষকতার পেশায় এসেছিলেন।

বাবা-মা সন্তানের জন্ম দেন ঠিকই, কিন্তু তাকে সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষকরা মানুষের ভেতরকার সত্যিকারের মানুষটি সৃজন করেন। তাই শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা। জ্ঞান বা বিদ্যার্জনের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকাকে দ্বিতীয় জন্মদাতার সঙ্গে তুলনা করে কত কবি-সাহিত্যিক যে কতশত কবিতা-সাহিত্য রচনা করেছেন, তার হিসাব কষা কঠিন।

শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। কৃষক যেমন ফসলের চাষ করেন, তেমনি শিক্ষক করেন মানুষের চাষ। এ কারণেই শিশুদের উদ্দেশ্যে বলা হয়, পড়ালেখা করে মানুষ হও। এই মানুষ করার দায়িত্ব বেশিরভাগই শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত। এই শিক্ষকেরাই অতিশয় যত্নের মধ্য দিয়ে ছাত্রের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে তাকে তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়।

তবে আজকাল শিক্ষকের সম্মানের বিষয় রূপকথার মতো শোনায়। আগে বলা হতো শিক্ষকের সেবা করলে উন্নতি হয়, আর এখন শিক্ষককে পেটালে উন্নতি হয় বোধ করি। নাহলে হরহামেশাই শিক্ষকরা শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে লাঞ্ছিত হবেন কেন? অথচ দেশে কিন্তু শিক্ষার হার বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে এখন গ্রাজুয়েট, পিএইচডি-ড্ক্টরেট করা নাগরিকের দেখা মেলে! এই যে এত যে শিক্ষা, এই যে এত যে শিক্ষিত লোকের ছড়াছড়ি; কিন্তু সেখানে শিক্ষা কই?

নাহলে, কেন একজন শিক্ষার্থী তাঁর পিতৃতুল্য শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলবেন? কেন একজন শিক্ষার্থী তাঁর গুরু শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরাবেন? কেন একজন ছাত্র একজন শিক্ষককে কোপাবেন বা পাঁজাকোলা করে পুকুরে নিয়ে ফেলবেন? তাহলে শিক্ষকেরা যে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন, সেগুলো কোথায় গেল? সেই শিক্ষার জ্ঞানে কি তাহলে কোনো আলো নেই?

প্রশ্নগুলো উঠা স্বাভাবিক। এখন কোনো কিছুতে আর আগের গুন বা উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন আর— দইয়ে দুধ নেই, ফল-মূলে পুষ্টি নেই, মাঠ আছে খেলাধূলা নেই, শিক্ষায় জ্ঞান নেই, জ্ঞান থাকলে কদর নেই। সর্বোপরি মানুষে আর মানুষ নেই। এভাবে অনেক কিছুই ‘নেই’ হয়ে গেছে। এমনকি কবি কাজী কাদের নেওয়াজের সেই কবিতাটিও পাঠ্যবইয়ে নেই! তার বদলে সেখানে আছে মানহীন কোনো কবিতা। শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের আদর্শ গঠনের উপযোগী আগের অনেক গল্প-কবিতাই এভাবে ‘নাই’ হয়ে গেছে পাঠ্যবই থেকে! পরীক্ষার সিলেবাস বা প্রশ্নপত্রে ধর্মীয় গোড়ামি, উগ্রতা, কুসংস্কার জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

এই শিক্ষকেরা যে পাঠ্যবই পড়ান, তা নিজেরা রচনা করেন না। যে কাঠামোতে শিক্ষাদান করেন, সেগুলোও রাষ্ট্রের তৈরি করে দেওয়া। এসব প্রক্রিয়ার ভেতরে গলদ রয়ে যাচ্ছে। যারফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা পাচ্ছে তারমধ্যে সেভাবে আদর্শিক মনোভাব তৈরির উপাদান নেই। তাদেরকে গিনিপিগ বানিয়ে একেকবার একেক পদ্ধতি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে ফলাফলমুখী শিক্ষার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিক্ষকদেরও বলা হয়, জিপিএ-৫ বাড়াও, ভাল ফলাফল বাড়াও। কর্তৃপক্ষ খোঁজ খবর নিয়ে দেখে না যে শিক্ষার্থীরা আসলে শিখলোটা কী। মানহীন শিক্ষায় শিক্ষিত এই প্রজন্ম তাই শিক্ষকের মর্যাদা না বোঝারই কথা। ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও ভেঙে পড়েছে এখন।

আমরা আশির দশকে যখন প্রাথমিকে পড়তাম, শিক্ষককে বাবা-মায়ের সমকক্ষ ভেবেই শিক্ষালাভ করেছি। শিক্ষকদেরকে বাবা-মায়ের মতোই বাঘের মতো ভয় করেছি। এতে লাভের লাভ হয়েছে, এই এতদিনে এসে বুঝতে পারি। সেই সময়ের শাসন আর স্নেহের সংমিশ্রণে যে শিক্ষা, সেই আদর্শ শিক্ষায় আমরা বড় হয়েছি। আর এ জন্যই এখনো শিক্ষকদের দেখলে মাথা নিচু করে ফেলি। এই মাথা নিচু করা মানে নিজেকে ছোট করা নয়। এই অবনত মস্তক শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় উৎসর্গীত হওয়া।

এখন শাসন উঠে গেছে। ‍তুলে দেওয়া হয়েছে। এটি বড় একটি ভুল উদ্যোগ। অথচ সন্তানকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাকে শাসন ও স্নেহে বড় করতে হয়। মহামতি চাণক্য যেমনটা বলেছেন:

লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।

প্রাপ্তে তু ষোড়শবর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ।।

অর্থাৎ প্রথম পাঁচ বছর পুত্রকে স্নেহ দিয়ে লালন করবে। পরবর্তী ১০ বছর তাকে কঠোরভাবে শাসন করবে। ১৬ বছর বয়সে তার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করবে। হাজার হাজার বছর ধরে চাণক্যের এই নীতিবাক্যের সুফলের সত্যতা মিলেছে।

চাণক্যের সময়কাল থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁর পরামর্শ ও নীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বহুবিধ সাহায্য করেছে। ‘চাণক‍্য নীতি’ বইটিতে সন্তানদের সম্মুখে পিতা মাতার উচিত ব‍্যবহার সম্পর্কেও লিখে গিয়েছেন চাণক‍্য। তিনি বলেছেন, পিতা মাতার আচরণ সন্তানের ওপর খুব তাড়াতাড়ি প্রভাব ফেলে। তাই বাবা মায়ের উচিত সবসময় আদর্শ, নম্র স্বভাব ও সততার পরিচয় দেওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজ ও পরিবারে সন্তানকে শাসন কিংবা স্নেহ কোনোটিই সেভাবে এখন হয় না। সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে গত কয়েক দশকে। একান্নবর্তী পরিবারপ্রথা ভেঙে গিয়ে এখন জগাখিচুড়ি এক একক পরিবারের যুগ চলছে। যে পরিবারে এখন সন্তানের মনোজগত তো দূরে থাক, সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কী খাচ্ছে— সেসবের খোঁজ নিচ্ছে না কেউ। সন্তানরা প্রযুক্তিমুখী হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বাবা-মা থেকেও তারা আসলে একেকজন এতিম। এই প্রজন্ম তাই দিনকে দিন একাকী হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধছে।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা— সর্বত্রই এখন মানহীন এক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ক্ষেপণ চলছে। শিক্ষার্থীরা সনদ পাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষিত হয়ে উঠছে না তারা। এ কারণে দেশে ন্যয়ের পক্ষে কথা বলার লোক মেলে না। অথচ ক্ষমতা ও টাকার পক্ষে লোকের অভাব নেই। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জ্ঞানহীন একটি সমাজ গড়ে উঠবার কারণেই। ফলে আমরা পেয়েছি হুজুগে একটি প্রজন্ম।

অথচ একটি সমাজের চিন্তা করবার ন্যারেটিভ তৈরি করে দেন শিক্ষক এবং তার ছাত্ররা। বাকিরা সেখান থেকে ধার করে চলে এবং তারা সেটি অনুসরণ করার চেষ্টা করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এই চিন্তন প্রক্রিয়া সামাজিক আচার-ব্যবহারে প্রভাব ফেলে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা দেখেছি ৫২-এর ভাষা আন্দোলন অথবা ৭১ মুক্তিযুদ্ধসহ নানা আন্দোলন সংগ্রামে। আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামে ১১১১ শহীদ বুদ্ধিজীবীর ৯৯১ জনই ছিলেন শিক্ষক। অর্থাৎ এই শিক্ষক নামের বুদ্ধিজীবীরা শুধু দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে শুধু তার শিক্ষার্থীদেরই উদ্বুদ্ধ করেননি, নিজেরাও প্রাণপাত করা যুদ্ধে সেদিন ঝাপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের লেখনী বা অন্য কোনো উপায়ে।

কিন্তু স্বাধীনতার পরে দেশের সবচেয়ে পচনশীল জায়গা হয়ে গেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। কারণ, এখানে আর সবই হয় শুধু চিন্তা ও জ্ঞানের চর্চা ছাড়া। তারই প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে এখন।

আমরা এখন যে বখে যাওয়া ছাত্র বা অন্যায় দেখেও দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখি, তা এই সমাজ-রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই উৎসারিত। যে শিক্ষায় এই প্রজন্ম শিক্ষিত হচ্ছে সেই শিক্ষায় কোনো আলো নেই। আলো নেই তো নেই-ই, উল্টো আছে দলা দলা অন্ধকার। শিশুদের পাঠ্যবইয়ে সেই আদর্শশিক্ষার বাণী নেই। সেখানে স্থান করে নিয়েছে ধর্মীয় উগ্রতা বা গোড়ামীপূর্ণ কনটেক্সট। রাষ্ট্রপরিচালকরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তারা একটিবারও খোঁজ নিয়ে দেখছেন না শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে আসলে হচ্ছেটা কি। শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদ করে ব্যবস্থা না নিলে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এটি হয়ে উঠবে বিশাল এক বিভীষিকার বিষয়। ধংসের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার আগে তাই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভেবে দেখতে হবে।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

Link copied!