সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে দিন দিন বেড়েই চলছে সাইবার অপরাধ। পাশাপাশি নারীদের জন্য আরও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে মাধ্যমগুলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি অংশ নারীদের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য পোস্ট করে, সামাজিক মাধ্যম বা প্ল্যাটফর্মে তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনকে উন্মোচিত করে দেওয়ার কারণে নারীরা সাইবারস্পেসে ক্রমবর্ধমানভাবে ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকার হচ্ছেন। এক বছরে ১৭ হাজার ২৮০টি অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ।
বছরে ১৭ হাজার অভিযোগ
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, গত এক বছরে ১৭ হাজার ২৮০ জন মহিলা উইংয়ের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং তাদের মধ্যে ১২ হাজার ৯৪১ জন সাইবার বুলিং সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। পুলিশ সদর দপ্তর ১৬ই নভেম্বর, ২০২০ এ মহিলাদের জন্য পুলিশ সাইবার সহায়তা নামে একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে। যেখানে একটি ডেডিকেটেড হটলাইন, একটি ফেসবুক পেজ এবং একটি ইমেল ঠিকানা রয়েছে। যেখানে ভুক্তভোগী নারীরা সাহায্য এবং পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করতে পারবেন। এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই নিয়মিতভাবে নারীদের বিরুদ্ধে সাইবার বুলিং নিয়ে প্রচুর অভিযোগ পেয়ে আসছে।
ভুয়া একাউন্ট থেকে হয়রানি হচ্ছে বেশি
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন সহকারী মহাপরিদর্শক মীর আবু তৌহিদ, যিনি উইংয়ের সমন্বয়কারী, তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেছেন, যে তারা সময়ের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে অভিযোগ পেয়ে আসছেন। তিনি আরও বলেন, পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে ৪৩ শতাংশ অভিযোগ ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির সাথে সম্পর্কিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তার মতে, বেশিরভাগ ভুক্তভোগী নারী আরও হয়রানি ও সামাজিক অবমাননার ভয়ে আনুষ্ঠানিক মামলা করতে অনিচ্ছুক।
অ্যাকাউন্ট ভিত্তিক অপরাধ বেশি
নারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাক হওয়া, ভুয়া একাউন্ট, ব্যবসায়িক পেইজ নিয়ন্ত্রণে নেয়া এ ধরনের অপরাধ বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া সাইবার বুলিং, অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অপরাধের শিকারও হয় নারীরা। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সাইবার অপরাধীদের শিকারে পরিণত হচ্ছে।
কিশোর-কিশোরীদের পর মধ্যবয়সীরাও হয়রান
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কারো ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করা। কিশোর-কিশোরীরাই প্রথম দিকে এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছিল। এখন মধ্যবয়সীরাও এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম ভার্চুয়াল জগতে ভুয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন প্রতারণা ও বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কে তথ্য পায়। র্যাব শুধু মাঠ পর্যায়ে নয় ভার্চুয়াল জগতেও যারা ভুয়া পরিচয় প্রদান করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে। ফলশ্রুতিতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগী নারী বেশি
সাইবার অপরাধীদের শিকার ৫২২ জনকে নিয়ে বাংলাদেশে পুলিশের এক গবেষণায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের ৭০ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে ২৫ বছরের কম বয়সী নারী ৫৭ শতাংশ। সাইবার অপরাধের ধরনের মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি ৭ শতাংশ, সাইবার পর্নোগ্রাফি ১৪ শতাংশ, হ্যাকিং ২০ শতাংশ, মানহানি ১৮ শতাংশ, ভুয়া আইডি ২০ শতাংশ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ। সাইবার অপরাধের ভিকটিম ৫৮ শতাংশই ফেক আইডি এবং আইডি হ্যাক করে মানহানিকারী অপরাধীর শিকার।
হয়রানির পর অভিযোগ কম
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। হয়রানি সংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে আট হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ এবং সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
সমীক্ষা অনুসারে, গত এক বছরে, ১ হাজার ৩২১ জন মহিলা অভিযোগ করেছেন যে তাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হচ্ছে, প্রায় ১ হাজার জন বলেছেন যে তারা অশ্লীল ছবি, পাঠ্য এবং ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং ১ হাজার ৪৫১ জন সেলফোন কলে হয়রানির অভিযোগ করেছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, এক বছরে যারা অভিযোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৪৭৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে এক হাজার ৮৮৪ জন নারীকে। আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানি করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন এক হাজার ৫১৮ জন। অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।
ঢাকায় অভিযোগ বেশি
ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভুক্তভোগী এই সেলে অভিযোগ করেছেন, যা মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ; খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ; বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন। ‘সাইবার স্পেস নারীসেবা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে একবছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। বাংলাদেশ পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিশ্বাসী নারীর বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ রোধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নির্মাণে ভূমিকা রাখতে এক বছরের পথ অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’।
সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, দেশের মানুষ এখনো ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নয়। প্রায়ই মহিলাদের বিরুদ্ধে সাইবার বুলিং সম্পর্কে অভিযোগ পাই এবং ভুক্তভোগীদের মামলা দায়ের করতে বলি, কিন্তু অনেক ভুক্তভোগী উত্তর দেয় যে পুলিশের মামলা দায়েরের পদ্ধতি জটিল।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, র্যাব শুধু মাঠ পর্যায়ে নয় ভার্চুয়াল জগতেও যারা ভুয়া পরিচয় প্রদান করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রেখে চলেছে। ফলশ্রুতিতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে।
নারী অধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশ ও সংস্কৃতি নারীবান্ধব নয় এবং নারী নির্যাতনের শিকার নারীরা আইনি পদক্ষেপ নিতে ভয় পায়।