বাংলাদেশে শনাক্ত করোনাভাইরাসের ধরনগুলোর মধ্যে এখন প্রতি পাঁচ জনে চারজনই দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়ান্টের ভাইরাসে আক্রান্ত। এ ধরনটির আবির্ভাবে বাংলাদেশে ভাইরাস বিস্তারের ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড গড়ছে। আর সেজন্যই ধারণা করা হচ্ছিল যে, সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোন না কোনো পরিবর্তন হয়তো হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলছেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়ান্টের মাধ্যমে যারা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আগে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বেশ কিছু পার্থক্য বা এক্ষেত্রে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এগুলো অন্য ভ্যারিয়ান্টের চেয়ে মারাত্মক ও জটিল। এটি ছড়িয়েও পড়তে পারে দ্রুততায়।
রোগীকে দ্রুতই ঘায়ের করে ফেলে
ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত সেবা দিচ্ছেন হাসপাতালটির মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফজলে রাব্বী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথম দফার তুলনায় এবারে রোগীদের একটি অংশের মধ্যে অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ার একটি প্রবণতা চিকিৎসকরা দেখতে পাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, অনেককে আক্রান্ত হওয়ার ৬/৭ দিনের মধ্যেই উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন দিতে হচ্ছে এবং তা-ও আবার সেটি তুলনামুলক দীর্ঘ সময়, যেমন ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। চলতি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা একটু খারাপ হলে তা দ্রুতই খারাপতর হয়ে যাচ্ছে।
ওই চিকিৎসক আরও বলেন, আগে আইসিইউতে কোন রোগী এলে বেশিরভাগকেই আমরা ৮/১০ দিনের মধ্যে রিকভারি করে কেবিনে পাঠাতে পেরেছি। কিন্তু এবার সেটি হচ্ছে না। এবার অনেক দীর্ঘ সময় লাগছে এবং আইসিইউ থেকে অনেকে আবার ফিরতেও পারছেন না। মূলত অনেকেরই ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে এবং রক্ত জমাট বাঁধছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিলো ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে এবং তখন চিকিৎসরা এর উপসর্গ হিসেবে জ্বর, শুষ্ক কাশি, শরীর ব্যথার মতো উপসর্গের কথা জানিয়েছেন।
এখন গবেষকরা বলছেন যে বাংলাদেশে বর্তমানে করোভাইরাসের দুটো নতুন ভ্যারিয়ান্ট ছড়িয়েছে এবং এদের মধ্যে ইউকে ভ্যারিয়ান্ট শুরুতে শনাক্ত হলেও এখন সবচেয়ে বেশি প্রকোপ দক্ষিণ আফিকার প্রজাতিটির। রোগীদের চিকিৎসার সাথে সরাসরি জড়িত চিকিৎসকরা বলছেন যে নতুন ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্তদের মধ্যে নানা নতুন বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছেন তারা।
নতুন উপসর্গের পার্থক্য
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্যাটার্ন আগের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। প্রথম ওয়েভের সময় আক্রান্তদের মধ্যে অনেককে ৭-৮ দিন পার হওয়ার পর অক্সিজেন দিতে হয়েছিলো, কিন্তু এবারে দিতে হচ্ছে আরও আগেই।
এছাড়া, এবারে আক্রান্তদের অনেকের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের উপসর্গ আরও প্রকট দেখা যাচ্ছে - বিশেষ করে অনেকের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে বলে জানান এই চিকিৎসক। এবার নিউরোসাইক্রিয়াটিক সমস্যা, যেমন কারও কারও মধ্যে পাগলামি আচরণের প্রবণতা কিংবা ব্রেইন ইনফেকশনের মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে।
হাসপাতালে এমন অনেক রোগী তারা পাচ্ছেন, যাদের রক্তের অনুচক্রিকার সাথে হিমোগ্লোবিনও কমে যাচ্ছে, যদিও তাদের আগে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার রোগ বা রেকর্ড ছিল না। অথচ গত বছর প্রথম দফার সংক্রমণের সময় অনেকের রক্তের অনুচক্রিকা কমলেও তখন হিমোগ্লোবিনের সমস্যা রোগীদের মধ্যে পাওয়া যায়নি। আর এসব নতুন ধরণের সমস্যার কারণে অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়ে অনেককে খুব তাড়াতাড়ি আইসিইউতে নিতে হচ্ছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থার পার্থক্য
রাজধানীর একটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের কনসালটেন্ট বলেন, আগে আইসোলেশনে থাকার সময় চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে উঠতো বেশিরভাগ রোগী। কিন্তু এখন ফুসফুস খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অক্সিজেন লেভেলও আগের তুলনায় দ্রুত কমে যাচ্ছে।
আগে রিকভারি হতে সময় লাগতো ৫/৬ দিন। কিন্তু এখন যাদের রিকভারি হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রেও আরও বেশি সময় লাগছে।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে আসা রোগীদের অবস্থা দেখে কোভিড চিকিৎসায় সরাসরি জড়িত এই দুই চিকিৎসক মনে করছেন যে এবারের ভ্যারিয়ান্ট খুব দ্রুতই রোগীদের অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে, ফলে অনেক রোগীকে সুস্থ করে তোলা কঠিন হয়ে পড়ছে।