শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়! যন্ত্র জন্ম দিবে সন্তান! অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। তাহলে একটা প্রশ্ন তো অবধারিতভাবেই ওঠে, যন্ত্রের কি প্রাণ আছে?
হ্যাঁ, আছে।
২০২০ সালে আমেরিকার ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এমন এক বিরল ‘জীবনকে’ গবেষণাগারে তৈরি করেছিলেন। আফ্রিকার এক ধরনের ব্যাঙ (জেনোপাস লেভিস)-এর স্টেমসেল (কোষ) ব্যবহার করে এটিকে তৈরি করা হয়েছিল। তাই তার নামানুসারে যন্ত্রটির নাম রাখা ‘জেনোবট’।
বিজ্ঞানীদের কথায়, এই জেনোবট পৃথিবীর প্রথম ‘জ্যান্ত রোবট’। ১ মিলিমিটারের থেকেও ক্ষুদ্র যন্ত্রটি মানুষের শরীরের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। সেখানে নির্বিঘ্নে হেঁটে-চলে-সাঁতরে বেড়াতে পারে। বিনা খাবারে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাঁচতে পারে। এবং মানবদেহের ভেতরে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। কোনোভাবে জখম হলে, নিজেই সারাতে পারে নিজের ক্ষত।
বিস্ময়ের তালিকা দীর্ঘ। ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাখ্যায়, ‘‘সম্পূর্ণ নতুন একটি জীবন।’’
২০২০-র আবিষ্কারের প্রায় দু’বছরের বছরের মাথায় এবার আরও একটি সুখবর দিলেন আমেরিকান বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি তারা জানালেন, জীবন্ত রোবটগুলি সন্তানের জন্মও দিতে পারে!
সাম্প্রতিক গবেষণায় ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আমেরিকার আরও দুই বিশ্ববিদ্যালয়, টাফটস এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস ইনস্টিটিউট। এই গবেষণাকে তারা বলছে, ‘বায়োলজিক্যালি ইনস্পায়ারড ইঞ্জিনিয়ারিং’।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, জেনোবটের প্রজনন ক্ষমতা একেবারে ভিন্ন। প্রাণী বা উদ্ভিদ জগতে যে ভাবে প্রজনন হয়, এর সঙ্গে তার কোনও মিল নেই।
এই গবেষণার অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় থাকা বিজ্ঞানী, টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন ডিসকভারি সেন্টারের ডিরেক্টর, তথা জীববিশেষজ্ঞ মাইকেল লেভিন বলেন, ‘‘আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ব্যাঙের একটি নিজস্ব প্রজনন ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তার কোষগুলিকে যখন ভ্রূণ থেকে আলাদা করা হয়েছে, একটি নতুন পরিবেশে নিজেদের মতো বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তারা শুধু নিজেদের মতো চলার রাস্তা খুঁজে নেয়নি, প্রজননের পথও বার করে নিয়েছে!’’
স্টেম কোষ জীবদেহের এক ধরনের বিশেষ কোষ। এদের নতুন কোষ তৈরির ক্ষমতা থাকে। জ়েনোবট তৈরিতে ব্যাঙের ভ্রূণ থেকে স্টেম কোষগুলি সংগ্রহ করে সেগুলিকে ইনকিউবেট (কোনও উষ্ণ জায়গায় রেখে প্রাণ সঞ্চারিত হতে সাহায্য করা) করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে কোনও রকম জিন পরিবর্তন ঘটানো হয়নি।
কিন্তু এটি কি জীবন্ত রোবট নাকি নতুন জীব? জবাব হল— দু’টোই।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও রোবোটিক্সের অধ্যাপক জশ বোনগার্ড। তিনি বলেন, ‘‘রোবট শুনলেই বেশির ভাগ লোক মনে করেন, ধাতু বা সিরামিকস দিয়ে তৈরি কিছু। কিন্তু রোবটের অর্থ সেটা নয়। রোবট হল এমন কিছু, যা মানুষের হয়ে নিজের মতো কাজ করে যেতে পারে।’’
বোনগার্ডের কথায়, ‘‘এটা রোবটই। তবে হ্যাঁ, এটি একটি জীবও। ব্যাঙের কোষ থেকে কোনও রকম জিনগত পরিবর্তন না ঘটিয়ে এটিকে তৈরি করা হয়েছে। এটি চিরাচরিত ভাবে চেনা রোবট নয়, আবার কোনও নতুন প্রাণীর প্রজাতিও নয়। নতুন ধরনের আর্টিফ্যাক্টস। বলা যায়, জীবন্ত, নিয়ন্ত্রণযোগ্য জীব।’’
এক মিলিমিটারেরও কম, ০.০৪ ইঞ্চি মাপের জেনোবটের একটি নির্দিষ্ট দৈহিক গঠন আছে। সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে সেই গঠন তৈরি করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এমন একটি আকার এদের দেওয়া হয়েছে, যা জীবজগতে আগে ছিল না।
প্রশ্ন হল, মানুষের হয়ে কোন কাজটা করে দেবে ০.০৪ ইঞ্চির জ়েনোবোটরা?
এদের কাজ কি? বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপুল কর্মকাণ্ড। সেনাবাহিনীতে ব্যবহার করা হবে এদের। কী ভাবে, তা অবশ্য ব্যাখ্যা করেননি কেউ। উল্লেখ্য, এই গবেষণায় অর্থায়ন করেছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগ।
এছাড়া, চিকিৎসায় ব্যবহার করা হবে একে। মানুষের শরীরের ভিতরে এর সাহায্যে ওষুধ পাঠানো হবে। ধমনীতে রক্তপ্রবাহে বাধা তৈরি হলে, তা সারাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া, সেল বায়োলজির গবেষণাতেও সাহায্য করবে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিষ্কার বা সমুদ্র থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক সংগ্রহের মতো কাজও নিমেষে করে ফেলবে ‘জীবন্ত রোবট’।
সূত্র: আনন্দবাজার