গল্প কিংবা উপন্যাস যাই হোক না কেন শহীদুল জহির তার শুরুটা এত অসাধারণ, এত বেশি দূর্দান্তভাবে করতেন যে তারপর পুরো গল্পজুড়ে সেই রেশ থেকে যেতো। তার ‘ডলু নদীর হাওয়া’ গল্পের চরিত্র তৈমুর আলী চৌধুরী ইজি চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় তার অণ্ডকোষ বের হয়ে থাকার যে বর্ণনা শহীদুল জহির দেন তা পাঠকের মনে প্রথমেই যে ধাক্কা দেয় তা তার মস্তিস্কে চিরস্থায়ীভাবে বসে যায়। ওই দৃশ্য থেকে আর বের হওয়া হয়ে ওঠে না পাঠকের। কিংবা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের মূল চরিত্র জীবনের আবাদকারী মফিজুদ্দির মহাপ্রয়াণের রাতে পূর্ণিমার যে দৃশ্যায়ন করা হয়, চাঁদকে রক্তাক্ত ছিন্নমুণ্ডুর সাথে তুলনা দেওয়া হয় সেটি যে বাংলা সাহিত্যে অন্য কোন ঔপন্যাসিক করেননি তা অবলীলায় বলে দেয়া যায়। কিংবা তার আরেক উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তব্তার’ সূত্রপাত হয় একজন যুবক আব্দুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে। এই যে সূচনায় নতুনত্ব তা আসলে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য ঢঙ।
শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাসের ভাষা নিয়ে নানামত আছে। প্রমিত ভাষার বাক্যের মাঝে মাঝেই তিনি টেক্সট এবং ডায়লগে কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষারীতি ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে পুরান ঢাকার ভাষায় তার সংলাপ নির্মাণ অনবদ্য। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখতে পারি বিভিন্ন আঞ্চলিক ক্রিয়াপদের ব্যবহারে তার মুন্সিয়ানা। যেমন, যায়া (গিয়ে/যেয়ে), খায়া (খেয়ে), হয়া (হয়ে), হারায়া (হারিয়ে), শিখায়া (শিখিয়ে), দিয়া (দিয়ে) প্রভৃতি। ভাষা কেন্দ্রিক যে এলিটিজম তা শহীদুল জহির মানতে চাননি। প্রবলভাবে বিদ্রোহ করেছেন প্রমিত এবং আঞ্চলিক শব্দকে একসাথে ব্যবহার করে। তিনি ভাষাকে নতুন করে পরিসঞ্চালন করতে চেয়েছেন। এপ্রসেঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আসলে আমি ভাষাশিল্পী না।…আমি ভাষা সৌন্দর্যের প্রাসাদ তৈরি করতে চাই না।…আমি যাদের কথা বলি, যেভাবে বলি তাতে এই ভাষায় (কথ্যভাষা) প্রাণ’।
আমরা দেখি শহীদুল জহির সাহিত্যে বাস্তবের মতো হুবহু চরিত্র নির্মাণ ও বাস্তব জীবনে ব্যবহৃত ভাষার ব্যবহারে বিশ্বাসী ছিলেন তার লেখায়ও। যেসব শব্দ আমাদের জীবনের চারদিকে, চারপাশে ঘুরে বেড়ায় তাইই তিনি কুড়িয়ে কুড়িয়ে ব্যবহার করেছেন তার লেখায়।
শহীদুল জহির যা লিখেছেন তা জাদু বাস্তব নাকি পরাবাস্তব সে নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। তবে আমরা একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারি তা হলো তার লেখায় জীবন, বাস্তবতা যেন ফিনিক ফোঁটা জ্যোৎস্নার মতো ঝিক করে উঠে আমাদের চোখের সামনে। আর তার উপস্থাপনার ঢঙে মনে হয় তার লেখা যেন আমাদের সামনে বহুদূরের কিন্তু আসলে কাছের, হাজার বছরের পুরনো গল্পের আনকোরা উপস্থাপন।
শহীদুল জহির ৮০ দশকের শক্তিমান ঔপন্যাসিক। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসটি সম্বন্ধে বলেছেন, ‘তিনি নব্বইয়ের দশকে যে দুটি উপন্যাস এক নিঃশ্বাসে শেষ করেছেন- তার একটি শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’।
জহিরের সব লেখাই এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলার মতো। শেষ না করা পর্যন্ত পাঠককে ধরে রাখার ক্ষমতা যেন তার সহজাত। প্রকৃতপক্ষে শহীদুল জহিরের উপন্যাস বা গল্প যাই বলি না কেন তার শুরুটা ইংরেজি বলতে পারি ‘শকিং’। সেই ‘শকিং’ আরম্ভের পর আর থামা যায় না, শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত। ঝরঝরে লম্বা বা কখনো ছোট ছোট বাক্যে শহীদুল জহির যে জীবন আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন তার সাথে এগিয়ে যেতেই হয়। একটা ঘোর তৈরী হয় তার লেখা পড়তে গেলে।
এ সম্পর্কে শহীদুল জহির নিজেই একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ঘোর আমি তৈরি করি এবং সেটা পাঠককে সম্পৃক্ত করার জন্য করি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য আমি পাঠকদের বিভ্রান্তও করতে চাই, তবে বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্য সেটা করি না।...আমি পাঠকদের কাছ থেকে অনেকবেশি মনোযোগ দাবি করি।…আমার অনেক লেখায় আমি ঘোর তৈরি করে তার ভেতরে মূল বিষয়টা ছেড়ে দিয়েছি’।
সবমিলিয়ে শহীদুল জহিরের লেখার ধরনটা আলাদা- এক নাগাড়ে গল্প বলে যেতে থাকেন তিনি, লাফিয়ে লাফিয়ে এক ঘটনা থেকে চলে যান আরেক ঘটনায়। ফলে অনভ্যস্ত পাঠকের জন্য একটু আয়াসসাধ্য মনে হতে পারে। আবার একই সাথে ব্যতিক্রমী ভাষার জন্য ভালো লাগার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
শহীদুল জহিরের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হলো পারাপার (১৯৮৫), জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮), সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (১৯৯৫), ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (১৯৯৯), ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪), মুখের দিকে দেখি (২০০৬) এবং আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (২০০৯, মরণোত্তর)।
১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে পুরান ঢাকার ভজহরি স্ট্রিটের ভূতের গলির ৩৬ নম্বর বাসায় জন্মগ্রহণ করা এই সাহিত্যিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে। ২০০৮ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন শহীদুল জহির বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।