করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর লকডাউন চললেও প্রতিদিনই মৃত্যুমিছিলে যোগ হচ্ছে প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি মৃতদেহ।শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ব্যাপক ভ্যাকসিনেশন ও বিধিনিষেধ মেনে চললে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
করোনায় গত এক সপ্তাহে মৃত্যুর চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সবশেষ তথ্যে জানা যায় বুধবার (২৮ জুলাই) গত ২৪ ঘন্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আরও ২৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ১৬ জনে। এসময়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬ হাজার ২৩০ জন যা একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা। দেশে সর্বমোট ১২ লাখ ১০ হাজার ৯৮২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েক দিনের পরিংসখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড ২৫৮ জনের মৃত্যু হয়। সোমবার (২৬ জুলাই) গত ২৪ ঘন্টায় ২৪৭ জন,রবিবার (২৫ জুলাই) ২২৮ জন, শনিবার (২৪ জুলাই)১৯৫ জন, শুক্রবার (২৩ জুলাই) ১৬৬ জন, বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) ১৮৭ জন মারা গেছেন। অর্থাৎ গত ২২ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহে দেশে দেড় হাজরের বেশি (১৫১৮ জন) লোক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
করোনায় এক সপ্তাহের শনাক্তের চিত্র
অন্যদিকে, করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। বুধবার (২৮ জুলাই) দেশে করোনায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ২৩০ জন। মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) একদিনে ১৪ হাজার ৯২৫ জন, সোমবার (২৬ জুলাই) ১৫ হাজার ১৯২ জন, রবিবার (২৫ জুলাই) ১১ হাজার ২৯১ জন, শনিবার (২৪ জুলাই) ৬ হাজার ৭৮০ জন, শুক্রবার (২৩ জুলাই) ৬ হাজার ৩৬৪ জন, ও বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) ৩ হাজার ৬৯৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।এই হিসেবে গত ২২ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহে ৭৪ হাজার ৪৭৯ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য মতে দেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৬৯ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। আর চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৯ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী। বর্তমানে দেশে এত বিপুল সংখ্যক করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তবে সরকার জরুরি ভিত্তিতে করোনা রোগীদের জন্য আরও অধিক সংখ্যক শয্যা, আইসিইউ ও অক্সিজেন সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়ার পাশখাপাশি ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোর অবস্থা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে পাওয়া গত সপ্তাহের হিসেবে অনুযায়ি, দেশে যতগুলো করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল রয়েছে তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ হাসপাতালের ৭৫ ভাগ বেডে রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। বর্তমানে দেশে ৩৩৬টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ২৪ টিতে কোনো বেড খালি নেই। প্রতিটি হাসপাতালের আইসিইউ বেডও করোনা রোগীর দখলে।
গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত দেশের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর ৮৭ ভাগ আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি ছিলেন। গত ২৫ জুলাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, যদি এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকে তাহলে হাসপাতালে কোনো জায়গা থাকবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ীসহ দেশের অন্তত ২৪টি জেলা অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। এই জেলাগুলোতে করোনা সংক্রমণের গড় শতকরা হার ৩০ এর বেশি। সবচেয়ে বেশি রাজবাড়ী জেলায় ৫৩ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বরিশাল। এ জেলায় করোনা সংক্রমণের হার ৫১ শতাংশ। চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার ৪০ শতাংশ। অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা ২৪ হাসপাতালের মোট বেডের চারভাগের তিনভাগ এরই মধ্যে করোনা রোগীতে ভর্তি। সংক্রমণ বাড়া্র প্রবণতা অব্যাহত থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
করোনায় নারী মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গত কয়েকদিন থেকে দেশে করোনায় নারী মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে। ২০২০ সালের শুরু থেকে দেশে করোনায় মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মৃত্যু বাড়ছে। অথচ কয়েক মাস আগেও করোনায় মৃতদের মধ্যে এক পঞ্চমাংশ নারী ছিল না।
বুধবার গত ২৪ ঘন্টায় মৃত ২৩৭ জনের মধ্যে পুরুষ ১৪৯ জন ও নারী ৮৮ জন। এর আগের দিন মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) করোনায় মৃত ২৫৮ জনের মধ্যে পুরুষ ১৩৮ জন, আর নারী ছিল ১২০ জন। গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে পুরুষ মারা গেছেন ১৩ হাজার ৪৭৮ জন এবং নারী ৬ হাজার ৩০১ জন।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার
দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন, কঠোর লকডাউন দিলেও করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না যদি জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সতর্ক না হন। পাশাপাশি জনগণকে ব্যাপক করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে।
বুধবারও (২৮ জুলাই)স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেছেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো এই মহামারি মোকাবিলার একমাত্র পথ নয়। সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। মানুষের কাছ থেকে মানুষের যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে না যায় তাহলে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যার ওপর চাপ কমে আসবে। ‘
তিনি জানান, বিভিন্ন জেলায় বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ আছে। এই উদ্যোগটিকে আবারও চালু করতে পারবো বলে আমরা আশা করি। আমাদের প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলোজিস্টের স্বল্পতা আছে। সীমিত সংখ্যা নিয়েই আমরা চেষ্টা করছি সার্ভিসটি চালু রাখতে।
এদিকে, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বলেন ‘অতীতে আমরা দেখেছি মোট করোনা রোগীর তিন ভাগের দুই ভাগই ঢাকা ও ঢাকার চারপাশের, তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীদের তিন-চতুর্থাংশই ঢাকার বাইরের।
আইইডিসিআরের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রধান অস্ত্রগুলোর একটি হলো দেশের চলমান কঠোর লকডাউন। আগেও লকডাউন বা বিধিনিষেধ দিয়ে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল হয়েছে।
দেশের আরেক বিশিষ্ঠ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক মাহমুদ হুসেইন মনে করেন, ঈদের সময় কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করে দেওয়ার জন্যই করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যু ও শনাক্ত বেড়ে গেছে।
গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘করোনার ডেলটা ধরণ সম্পর্কে এখনও অনেক লোক জানে না। আগে আমরা করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য বললেও এখন জণগণ করোনায় আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। বিশেষ করে যাদের বয়স ৫০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে তাদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেই কারণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের করোনার ধরন ডেল্টায় পরিণত হয়ে যেতে পারে।
স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছেন। বুধবার (২৮ জুলাই) সচিবালয়ে সংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কেবল লকডাউন দিয়েই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব না। এটা সংক্রমণ রোধের একটি উপাদান মাত্র। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে হলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
লকডাউন আর বাড়ছে না
সারাদেশে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে টিকা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে জানিয়ে বুধবার (২৮ জুলাই) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আগামী ৫ আগস্টের পর লকডাউন আর বাড়ানো হবে না। দেশে কোনো লকডাউন থাকবে না।
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে লকডাউনের পক্ষে নই। কেবল লকডাউন দিয়েই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব না। এটা সংক্রমণ রোধের একটি উপাদান মাত্র ‘
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে হলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক পরিধান করলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে মানুষ ৭০ ভাগ নিরাপদ থাকবে। তাই জনসাধারণকে মাস্ক পরা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’