বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি এশীয় প্যারাপাখি। হাঁসজাতীয় এই প্রজাতিটি একসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই নিয়মিত দেখা যেত। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে বিলুপ্ত পাখিটির শেষ ভরসা এখন বাংলাদেশর সুন্দরবন। দেশে যদিও এটি কালোমুখ প্যারাপাখি নামে পরিচিত। কিন্তু আবাসস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি সুপেয় পানির সংকটেও সুন্দরবন থেকেও বিলুপ্ত হতে পাবে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
ভারতেও বিলুপ্ত হচ্ছে প্যারাপাখি
বিশ্বে অবস্থিত ৩০২ টি প্যারাপাখির মধ্যে বাংলাদেশের সুন্দরবনে সর্বোচ্চ ১৬০টি প্যারাপাখি টিকে রয়েছে। কম্বোডিয়ায় এই প্রজাতির পাখি ৬৪টি, মিয়ানমারে ৪০টি, লাওসে ৩০টি, ভিয়েতনামে ৬টি এবং ভারতে ৪টি পাখি রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে এ পাখির প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৭ সালে এই পাখির সংখ্যা নিয়ে জরিপ হয়েছে। বাকি দেশগুলোয় জরিপ হয়েছে ১৯৯১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। ফলে গবেষক দলের ধারণা, এই সময়ের মধ্যে ভিয়েতনাম ও ভারত থেকেও প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পাখিবিজ্ঞান সাময়িকী ফর্কটেইল এর একটি সংখ্যায় গবেষণা নিবন্ধে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, বন্য প্রাণিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সমিতি এবং মালয়েশিয়ার মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও পাখি বিশেষজ্ঞদের একটি দল যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে।
বন্য প্রাণী ও পাখিবিষয়ক চারটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে, ম্যানগ্রোভনির্ভর এই পাখিকে মহা বিপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা জরুরি। গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সায়েম ইউ চৌধুরী। তিনি সুন্দরবনে এই পাখির ওপর এক যুগ ধরে গবেষণা করেছেন।
সকল জায়গায় বিচরণ
পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এশীয় প্যারাপাখির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তা পানি, মাটি ও গাছ—এই তিন জায়গায়ই বিচরণ করতে পারে। শক্ত পা আর নখ থাকায় এরা গাছ বেয়ে উঠতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য বিশ্বের খুব কম পাখির রয়েছে। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে, গাছের মধ্যে এরা ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থানের আশপাশের খালে এরা সাঁতরে বেড়ায়।
সকল জায়গায় বিচরণ করে বিধায় এটি স্পর্শকাতর। কেননা কোন জায়গা যদি কলুষিত হয় তাহলে এই প্রাণীর জীবনচক্রে প্রভাব ফেলে।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আবাসস্থলে মানুষের উপদ্রব বাড়লে এই পাখিরা সেখানে আর ডিম পাড়ে না। সুন্দরবনে গত কয়েক দশকে নানা স্থাপনা নির্মাণ, পর্যটন ও শিল্পায়ন হয়েছে। ফলে উপদ্রব বাড়ায় পাখির প্রজাতিটিও ওই সব এলাকা থেকে সরে যাচ্ছে।
কম্বোডিয়ায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সমিতির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও গবেষণা নিবন্ধটির সহলেখক সিমন মাহুদের মতে, বসতি ধ্বংস এবং মানুষের উপদ্রব এই পাখি ও নদীর বাস্তুতন্ত্রের অংশ অন্যান্য পাখির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে প্যারাপাখিকে বাঁচাতে হলে এর বাসস্থানগুলো রক্ষা করতে হবে।
সায়েম ইউ চৌধুরীর গবেষণায় দেখা গেছে, প্যারাপাখির ডিম পাড়ার স্থানটি গাছের খুব বেশি উঁচুতে হয় না। ফলে সুন্দরবনের জেলে ও পর্যটকেরাও এই পাখির ডিম নিয়ে যান। তবে এই বিপদ-আপদের মধ্যেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বন পাখিটির জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।
গবেষকদের সুপারিশ
এশীয় প্যারাপাখিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে গবেষকেরা এই পাখির সবচেয়ে ভালো আবাসস্থল বাংলাদেশের সুন্দরবন সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে, পূর্ব সুন্দরবনের স্বাদু ও নোনাপানির মিশ্রণে গড়ে ওঠা ব্রাকিশ ওয়াটার–সমৃদ্ধ এলাকা এদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। সেখানকার খাল ও তার পাড়ের এলাকায় এরা ডিম পাড়ে ও বিচরণ করে। কাজেই ওই সব এলাকা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছেন গবেষকেরা। এছাড়া সূক্ষ্ম সুতার জাল ও যাতায়াত সীমিত করার আহবান জানায় তারা।