দিনাজপুরে কান্তজিউ মন্দিরের সীমানায় দেবোত্তর সম্পত্তিতে একটি মসজিদ ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরুর পর স্থানীয় হিন্দুদের আপত্তির মুখে বন্ধ করে দিয়েছে দিনাজপুর জেলা প্রশাসন।
রাজ দেবোত্তর এস্টেট কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ রোববার (২৫ মার্চ) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে নোটিশ টাঙিয়ে দেন। এর চার-পাঁচদিন আগে এস্টেট কমিটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর এই আবেদন করা হয়।
এর আগে গত ১ মার্চ দিনাজপুর-১ (কাহারোল-বীরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য জাকারিয়া জাকা কান্তনগর জামে মসজিদটির বহুতল ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
এরপর থেকেই সেখানে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কারণ এস্টেটের সম্পত্তিতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। সেই অনুমোদন ছাড়াই মসজিদটির বহুতল করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
কান্তনগর গ্রাম জামে মসজিদটি দেবোত্তর সম্পতিতেই স্থাপিত বলে জানান মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুস সালাম। তার দাবি, ‘৭০ বছর আগে মসজিদটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্মতিতেই নির্মাণ করা হয়। তখন থেকেই গ্রামের মানুষ এখানে নামাজ আদায় করে আসছে। বর্তমানে লোকসংখ্যা বাড়ায় মসজিদে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ওই মসজিদ ভেঙে তিনতলা ভবন করা হচ্ছিল।’
মসজিদ কমিটির সভাপতি বলেন, ‘এত বছরে এই মসজিদ নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। এখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে আমরা এক সঙ্গেই অবস্থান এবং ধর্ম-কর্ম পালন করে আসছি। এত বছর পর এখন কেন তারা মসজিদ পুনর্নির্মাণে আপত্তি করছে আমরা বুঝতে পারছি না।’
জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মসজিদের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে বলে জানান আব্দুস সালাম।
এই বহুতল ভবন নির্মাণে এস্টেট কমিটির অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে মসজিদ কমিটির সভাপতি বলেন, ‘এটা আমরা জানতাম না।’
জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘আইন অনুযায়ী দেবোত্তর সম্পত্তিতে স্থাপনা নির্মাণে ট্রাস্টের অনুমতি নিতে হবে। বিনা অনুমতিতে কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করা যাবে না। এস্টেট কমিটির অনুমতি ছাড়াই সেখানে মসজিদ পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজ দেবোত্তর এস্টেট কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার্থে মসজিদ পুনর্নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সেখানে আগে থেকেই মসজিদ ছিল এটা সত্য। কিন্তু সেই মসজিদ ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছিল।’
দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য জাকারিয়া জাকা বলেন, ‘মসজিদটি অনেক পুরাতন। কিন্তু যেহেতু দেবোত্তর সম্পতিতে মসজিদটির অবস্থান, সেহেতু দেবোত্তর এস্টেটের ট্রাস্টি জেলা প্রশাসক যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
এস্টেটের অনুমতি ছাড়া মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে জাকারিয়া জাকা বলেন, ‘জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি বলেছি, আইন যা বলে তাই করেন।’
বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকারিয়া জাকা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চারবারের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
স্থানীয় মুসল্লিরা জানান, মনোরঞ্জনশীল গোপাল যখন সংসদ সদস্য ছিলেন তখন তিনি দুই দফায় মসজিদের অনুদান দিয়েছেন।
মসজিদের বহুতল ভবন নির্মাণের ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এস্টেটের অনুমোদন ছাড়াই মসজিদ পুনর্নির্মাণ করাটা অবৈধ, যেটা মসজিদ কমিটি করেছে।’
দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট হিসেবে রয়েছেন রণজিৎ সিংহ। সোমবার তার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি এই নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবো না।’
কান্তনগরে কান্তজিউ মন্দিরের অদূরে নয়াবাদ মসজিদ রয়েছে। কান্তজিউ মন্দির স্থাপনকালে রাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ মসজিদটি তৈরি করে দেন।
কথিত আছে, মন্দির নির্মাণে নিযুক্ত মুসলিম শ্রমিকদের নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। সেই মসজিদটিও টেরাকোটা সমৃদ্ধ। পরে মসজিদটি সরকারিভাবে সংস্কার করা হয়।
কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে মসজিদ ‘নির্মাণের’ উদ্যোগের খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এরই মধ্যে রোববার দেশের ১৭ নাগরিক এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন।
বিবৃতিতে তারা এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে প্রশাসন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।