ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহ এখনও খুঁজে পায়নি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নবাব নওয়াব আলী সিনেট অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “যে ফ্ল্যাটে এমপি আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কলকাতা পুলিশ সেখানে ঢুকেছিল, কিন্তু সেখানে লাশ পাওয়া যায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের মূলহোতাসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ডিবি তাদের আটক করেছে। কলকাতা পুলিশও দুইজনকে আটক করেছে।”
আরও পড়ুন: এমপি আনোয়ারুল আজিম হত্যার মূলহোতা আটক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
একই দিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির মহাপরিদর্শক অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, “সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি। আমরা বুঝতে পেরেছি তাকে হত্যা করা হয়েছে।”
মরদেহ নিয়ে এই অনিশ্চয়তা স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেক প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, আনারের মরদেহ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল নাকি খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছিল? ঝিনাইদহ-৪ আসনের এই সংসদ সদস্যের মৃত্যুর রহস্যময় পরিস্থিতি বিভিন্ন অনুমানের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। উঠেছে অনেক সংবেদনশীল প্রশ্নও। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন উঠে আসছে, সংসদ সদস্য আনার কে ছিলেন এবং তার অন্তর্ধান কেন এত কৌতুহলের উদ্রেক করছে?
কে ছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার?
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নিশ্চিন্তপুরের মধুগঞ্জ বাজারের প্রয়াত ইয়াকুব বিশ্বাসের ছেলে আনওয়ারুল আজিম আনারের জন্ম ১৯৬৮ সালের ৩ মে। ৪ ভাই ও ৬ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী।
আরও পড়ুন: বাবা হত্যার বিচার চাই: ডরিন
ফুটবলার থেকে সংসদ সদস্য আনার একজন দুর্দান্ত ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার দক্ষতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুরোধে কালীগঞ্জ পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। পরে ২০০৯ সালে তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আনার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হন। এছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এলাকায় জনপ্রিয় এই সংসদ সদস্য
অনার ছিলেন একজন প্রিয় প্রতিনিধি, যিনি তার উন্নয়নমূলক কাজ ও সামাজিক উদ্যোগের জন্য পরিচিত। সংসদ সদস্য হিসেবে তার অবস্থান সত্ত্বেও প্রোটোকল এড়িয়ে চলতেন তিনি। প্রায়শই মোটরসাইকেলে করে স্থানীয়দের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি তার এলাকায় জনসেবা করে এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবেও করেছেন জনসেবা। এলাকার মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছেন। এলাকায় কারও মৃত্যু হলে তার বাড়িতে যেতেন তিনি। এ জন্য এলাকায় তার সুনাম আছে। কখনও একই দিন একাধিক পরিবারের কাছে যেতেন।
আরও পড়ুন: এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন স্থানীয় কর্মী মনে করছেন, আনার হত্যার সঙ্গে পুরনো ব্যবসায়িক রেষারেষি বা চোরাচালানের যোগসূত্র থাকতে পারে। তারই পরিচিত কেউ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
আনার হত্যা: দলীয় নেতাদের বক্তব্য
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সুন্দরপুর-দুর্গাপুর উত্তর প্রদেশের চেয়ারম্যান ওয়াহিদুজ্জমান ওডু বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা কখনও ভাবিনি যে ভারতে চিকিৎসা নেওয়ার সময় কোনও সাংসদকে হত্যা করা হবে। এটা আমাদের এবং কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ক্ষতি। আমরা খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।”
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মতিউর রহমান মতি বলেন, “আমরা যখন জানতে পারি সে নিখোঁজ হয়েছে, তখন আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। তবে আমরা উদ্ধার প্রচেষ্টা সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট তথ্য পাইনি। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে জানতে পারাটা হৃদয়বিদারক। আমরা এই হত্যার কারণ জানতে এবং জড়িতদের জন্য ন্যায়বিচার চাই।”
আরও পড়ুন: নিখোঁজ এমপি আনারের মরদেহ কলকাতায় উদ্ধার
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “তিনি কানের চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। ১০ দিন পর তার হত্যার খবর শুনে আমরা হতবাক ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে শব্দ নেই। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশি দূতাবাস আমাদের অন্ধকারে রেখেছে। তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে কিনা তা আমরা এখনও জানি না। এ বিষয়ে আমি আর কোনও মন্তব্য করতে চাই না।”
মতিয়ার রহমান মতি যোগ করেন, “আমি শুনেছি এখনও (সংসদ সদস্যের) মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা জানি না কে বা কেন তাকে হত্যা করেছে। তবে আমরা খুনিদের জন্য ন্যায়বিচার চাই।”
আরও পড়ুন: ‘হত্যার পর খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে এমপি আনোয়ারুল আজিমকে’
কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন বলেন, “আমরা এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারি না। আমরা ন্যায়বিচার চাই ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে চাই।”
বিকেলে আনারের সহযোগী রুবেল হোসেনকে আনারের রাজনৈতিক অফিসের সিঁড়িতে ক্রন্দনরত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “ভারতে যাওয়ার আগে এমপি আনার আমাকে চেকগুলো গরিবদের জন্য সংরক্ষণ করতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ফিরে আসার পর তিনি সেগুলো বিতরণ করবেন। এখন গরিবদের কথা কে ভাববে?”
আনারের মৃত্যু ঘিরে রহস্য জট পাকিয়েছে। উঠে আসছে ন্যায়বিচারের আহ্বান ও প্রিয় এই সংসদ সদস্যের ভাগ্য সম্পর্কে অনেক উত্তরহীন প্রশ্ন।