ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ ও অনিয়ন্ত্রিত কাঠামোর ফলে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। সেন্টমর্টিনে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর বাস্তব অগ্রগতি নেই। নজরদারির অভাবে চলছে কচ্ছপ ও অন্যান্য প্রাণী নিধন। পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের বাস্তবায়ন,পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে আসে।
আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস
২২ শে মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। এবারের দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘আমরা সমাধানের অংশ #প্রকৃতির জন্য’। এবারের দিবসে সচেতনা ও যথাযথ পরিবেশ গড়ে তুলছে সকলের অংশগ্রহনের বিষয় জোর প্রদান করা হয়।
ধারণক্ষমতার ৪ গুণ পর্যটক সেন্টমার্টিনে
প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণক্ষমতার ৪ গুণের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করায় সেন্টমার্টিনের সাম্প্রতিক পরিবেশ খারাপ হচ্ছে। মূলত পর্যটকরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করছে। দৈনিক সেন্টমার্টিনের পর্যটন ধারণক্ষমতা ১৮৩৫ জন। কিন্তু চলতি মৌসুমে প্রতিদিন সেন্টমার্টিন যাচ্ছে প্রায় ৭ হাজার পর্যটক।
আর শীতকালে দৈনিক সর্বোচ্চ ২০ হাজার পর্যন্ত পর্যটকও আসছে। যার ফলে এর পরিবেশ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যটকের কারণে ৪০ শতাংশ কচ্ছপের আবাসস্থল ও ডিমপাড়ার স্থান নষ্ট হয়। এ ছাড়া ৪৮ শতাংশ কচ্ছপ মাছের জালের মাধ্যমে আটক ও নিধন হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকটা চুপিসারেই কোরাল, শৈবাল, ঝিনুক ইত্যাদি নিধন ও বিক্রি চলছে।
প্রায়ই মারা পড়ছে সেন্টমার্টিনের কচ্ছপ ও ডলফিন
প্রকল্প নিলেও অগ্রগতি নেই
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের (১৯৯৫) আওতায় ১৯৯৯ সালে সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। ওই ঘোষণার মাধ্যমে এই দ্বীপের পরিবেশের কোনো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আইনত দ-নীয় অপরাধ। এ উপলক্ষে ‘পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এটা বাস্তবায়ন করছে। ১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬.৭৬ শতাংশ। চলতি বছরে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৫.২৫ শতাংশ। এমন অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা দেখা গেছে।
স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা না থাকা
প্রকল্পের মাধ্যমে কোরাল দ্বীপের স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে জীববৈচিত্র্য,ইকো ট্যুরিজম ব্যবস্থান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা মূল লক্ষ্য ছিল। কয়েক দশক আগে সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দিতে স্থানীয়রা। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হোটেল ব্যবসায়ীদের কারণে স্থানীয়দের আয় কমে যাওয়ায় তারা দ্বীপের বিভিন্ন প্রজাতি সংরক্ষণ করছে বলেও প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়।
অনুমতি না নিয়েই চলে হোটেল বাণিজ্য
প্রকল্পে মূলত স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করার কথা থাকলেও প্রভাবশালী হোটেল ব্যবসায়ীদের কারণে স্থানীয়রা সম্পৃক্ত হতে পারছে না। এর মধ্যে ১০৬টি হোটেল ও মোটেল রয়েছে, যাদের নিজস্ব কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। এতে পর্যটক রাত্রিযাপন করায় দূষণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পর্যটকদের সচেতনতা জরুরী
পরিবেশ অধিদপ্ততরের পরিচালক (প্লানিং) মো. সোলায়মান হায়দার বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। আরও কত ফলপ্রসূ করা যায়, তার জন্য সব প্রক্রিয়া চলছে। সরকার উচ্চ পর্যায় থেকে কাজ করছে। কোনো অন্যায় অপরাধ একদিনে বন্ধ করা যায় না, অনেক সময় লাগে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ছেঁড়াদ্বীপ ব্যতীত জীবন্ত প্রবাল নেই। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও দূষণের কারণে প্রবাল, বিরল প্রজাতির কচ্ছপসহ প্রাণীরা বিপন্ন। প্রবালপ্রাচীরের স্তরে স্তরে পলিথিন-প্লাস্টিকসহ নানা দূষিত পদার্থ জমা হচ্ছে। ইদানীং সাইকেল আর মোটরসাইকেলে ঘোরাঘুরি বাড়ায় পর্যটকরা প্রান্তিক এলাকাগুলোয়ও দূষণ নিয়ে যাচ্ছেন।
লোকবলের অভাব
প্রকল্প বাস্তবায়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার প্রধান কারণ ডিপিপিতে চাহিত জনবলের অভাব ও দুর্গম এলাকার জন্য সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের দুর্বলতা। ডিপিপিতে ২৫টি পদ রাখার প্রস্তাব হলেও অনুমোদন পায় মাত্র ১০টি পদের, যার ফলে প্রকল্পের কোনো কাজ সময়মতো করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এখানে কাজ করানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
সেন্টমার্টিনে অবস্থিত প্রজাতির সংখ্যা
উল্লেখ্য, দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল রয়েছে। আরও রয়েছে ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির শৈবাল, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। এ ছাড়া ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে; আছে দুই প্রজাতির বাদুড় ও ৫ প্রজাতির ডলফিন।