মার্চ ১৪, ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন ও গণমাধ্যমের মধ্যে বহুল আলোচিত অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের জীবনাবসান হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ২৭তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই শিক্ষাবিদ তার দীর্ঘ একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ক্যারিয়ারের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে তার প্রশাসনিক নীতিমালা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা ছিল।
দাদা-নানার ভালোবাসায় এতো বড় নাম!
পুরো নাম আবু আহসান মোঃ সামসুল আরেফিন সিদ্দিক, তবে তিনি সাধারণত আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক নামে পরিচিত। ১৯৫৩ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকার ধানমন্ডির গ্রিনরোডে বাবার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবু বকর সিদ্দিক ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং মা হোসনে আরা সিদ্দিক গৃহিণী। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
জন্মের পর তার দাদা আতশ আলী সিদ্দিক, যিনি তৎকালীন সরকারি চাকুরে ছিলেন, পারিবারিক নাম সিদ্দিক-এর সঙ্গে সামসুল আরেফিন সিদ্দিক নামটি যুক্ত করে রাখেন। তার বাবা, আবু বকর সিদ্দিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সলিমগঞ্জে চিকিৎসক তাজুল ইসলামের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তার সন্তানের নাম জানালে, পরদিন নানা তার নাতির জন্য ‘আবু আহসান সিদ্দিক’ নামটি রাখার নির্দেশ দেন। এরপর দাদা এবং নানা দুজনের ভালোবাসায় রাখা নাম দুটি একত্রিত করে তার বাবা মোহাম্মদ আকিকার মাধ্যমে তার নামকরণ করেন আবু আহসান মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন সিদ্দিক।
ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি!
বাবার চাকরির বদলির কারণে আরেফিন সিদ্দিকের শৈশব-কৈশোর বিভিন্ন স্থানে কাটে। তিনি প্রথমে সিরাজগঞ্জের বিএল স্কুল এবং পরে ভিক্টোরিয়া স্কুলে পড়াশোনা করেন। খুলনায় তার বাবা বদলি হলে, তিনি দৌলতপুর মুহসীন স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৬৯ সালে এসএসসি এবং ১৯৭২ সালে সরকারি বিএল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন, তবে পরবর্তীতে ঢাকা কলেজে মাইগ্রেশন করে বিএসসিতে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে (১৯৭৪ সালে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়) বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে এমএস শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৭৫ সালে (১৯৭৭ সালে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৮ সালে ফল প্রকাশিত হয়) সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেওয়ার আগে তিনি বুয়েটে পিআর হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮২ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান এবং সেখানে ১৯৮৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরেফিন সিদ্দিক ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের নেতা হিসেবে পরিচিত আরেফিন সিদ্দিক দুই মেয়াদে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে কাজ করেছেন।
২০০৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০১৭ সালে উপাচার্যের দায়িত্ব শেষ করে পুনরায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০২০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০২৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন।
মেধাবী হলেও প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বির্তক
শিক্ষাজীবনে মেধাবী হলেও তার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি বহু বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন তার নীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতির প্রসার, শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন এবং একপেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সমালোচিত হন। তার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন, এবং বিশেষ মহলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল।
উপাচার্য হিসেবে তার দীর্ঘ মেয়াদকালকে অনেকেই প্রশাসনিক দক্ষতার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন, আবার কিছু লোক এটিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ফল হিসেবে ভাবেন, এবং এই নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েও নিয়মিত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতেন তিনি। এছাড়া ভিসির বাংলোতে তার সঙ্গে গভীর রাত অবধি শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীরা দেখা করতে পারতেন। এমন শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য এইসময় খুঁজে পাওয়া বিরল বলে মনে করেন অনেকেই।
তবে তার উপাচার্যত্বকাল একদিকে ছিল সংস্কারমূলক, অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নসহ সেশনজট কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে বারবার সমালোচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের নেতা হিসেবে তিনি দলীয় রাজনীতির প্রচার এবং প্রসারে সক্রিয় ছিলেন।
অধ্যাপক সিদ্দিক শিক্ষা ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, যেমন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান এবং জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। তবে এসব দায়িত্ব পালনকালে তার নিরপেক্ষতা এবং যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক একজন দক্ষ শিক্ষাবিদ হিসেবে মনে রাখা হবে, নাকি দলীয় রাজনীতির প্রভাবিত প্রশাসক হিসেবে মূল্যায়ন করবে— সেই বির্তক থেকেই যাবে।