কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, আতঙ্কে সাধারণ শিক্ষার্থীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪, ০৮:১১ পিএম

কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, আতঙ্কে সাধারণ শিক্ষার্থীরা

ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকতের অনুসারী আহত অপূর্ব চক্রবর্তী। ফেসবুক থেকে নেয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। 
বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ১২টার দিকে এ ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। রাত ৪টা পর্যন্ত মারামারির ঘটনা চলতে থাকে। এ ঘটনার রেষ ধরে শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) আরেক দফায় সংঘর্ষ হয়।

জানা গেছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে।

গতকাল রাতের ঘটনায় আহত হয়েছেন পলাশ রায় সৌরভ, অপূর্ব চক্রবর্তী, পল্লব মণ্ডল, অর্পণ কুমার বাপ্পি, বিপ্লব পাল, বর্ষণ রয়, কার্তিক কুমার। এরা প্রত্যেকেই ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকতের অনুসারী। অন্যদিকে  কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইনানের অনুসারীদের মধ্যে আহত হয়েছেন অভিষেক ভাদুড়ি, জয় দাস, অপূর্ব, ধ্রুব, চিন্ময়, রিদ্ধি, অভি ও প্রিতম।

ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পূজা শেষে রাতে জগন্নাথ হলে ডিজে পার্টি চলার সময়। সৈকতের অনুসারী ও ইনানের অনুসারীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। সে সময় ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এলেও পরদিন রাতে জগন্নাথ হল মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা চলাকালীন গেট দখল নিয়ে ধাক্কাধাক্কিকে কেন্দ্র করে আবারও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই গ্রুপ। এ সময় এক দফা মারামারিও হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে আরও জানা যায়, সংঘর্ষের কারণে কারণে কনসার্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন পরিস্থিতি সামাল দেন। একটি গ্রুপ ঘটনাস্থল ত্যাগ করে এবং অন্য গ্রুপ মাঠে অবস্থান করে।  পরবর্তীতে কনসার্টের শেষ মুহূর্তে আরেকটি বড় গ্রুপ হল মাঠে আসে। সে সময় চার নেতা কনসার্ট ত্যাগ করলে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঢাবি শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি দেখলাম কয়েকজন দৌড়ে নতুন বিল্ডিংয়ে উঠে পড়লো। পুকুর পাড়ে দেখলাম স্টাম্প, লাঠি, পাইপ নিয়ে শুধু মারামারি চলছে। কিন্তু কে কাকে মারছে সেটি আমি বুঝতে পারিনি।’

এ নিয়ে হল ছাত্রলীগের গ্রুপ দুটির সাথে কথা বললে দুই পক্ষই ভিন্ন মত পোষণ করেন।

ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী ঋভু মন্ডল দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, ‘প্রথমত যখন চার নেতা কনসার্টে এসেছিল, মমতাজের গান শেষ হলো। তখন তিন নেতা বের হচ্ছিল তখন গণেশ ঘোষ তার কর্মীসহ এমন অবস্থা তৈরি করেছে যাতে সৈকত ভাই বেরোতে না পারে। ফলে কর্মীদের মধ্যে একটা ছোট ঝামেলা তৈরি হলে সৈকত ভাই তাদের সাথে কথা বলে বের হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে ঘটনা সেখানেই থেমে গেলেও শেষ হয় না। 

তিনি আরও বলেন, সৈকত ভাই বের হয়ে গেলে জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে হট্টগোল তৈরি হয়। পরে আমরা আমাদের কর্মীদের নিয়ে ভেতরে চলে আসি। আনুমানিক রাত দুইটার দিকে হলের সভাপতি কাজল দাসের অনুসারী ও সাধারণ সম্পাদক অতনু বর্মনের অনুসারীরা একত্রিত হয়ে আমাদের ওপর হামলা করে। এখানে ইনান ভাইয়ের তিনটি গ্রুপ ও সাদ্দাম ভাইয়ের দুটি গ্রুপের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিল। তারা একত্রিত হয়ে নতুন ভবনের সেক্রেটারি ব্লকের তিনতলা ভাংচুর করে চার তলায় যেতে চায়। সেখানে কয়েকজন আহত হয়। হামলায় আমাদের ৮ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। 

ঋভু আরও বলেন, এই হামলায় হলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ রাজিব বিশ্বাস, গণেশ ঘোষ, সবুজ মন্ডলের গ্রুপ উপস্থিত ছিল। এদের হাতে স্টাম্প, রড, কাঠের টুকরো , এস এস পাইপ ছিল। পাশাপাশি সাদ্দাম ভাইয়ের দুইজন ক্যান্ডিডেট অরিত্র নন্দী ও সৌরভ চক্রবর্তীর একহাতে রড ও অন্যহাতে মদের বোতল ছিল।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোর্তাজা মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন সৈকতের অনুসারী আহত অপূর্ব চক্রবর্তী দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, এটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক। যাদের সাথে চলা-ফেরা করি, খাওয়া-দাওয়া করি তারাই আজ মারে। এই আক্রমণ অত্যন্ত লজ্জাজনক ও পূর্বপরিকল্পিত।

তিনি আরও বলেন, আমি আমার কর্মীদের ভেতরে যেতে বলে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে রাজিব বিশ্বাস ও গণেশ এসে আমার মাথায় ও চোখে রড দিয়ে আঘাত করে ফলে আমার চোখের কোণে কেটে যায় এবং মাথা ফেটে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে চলে আসি। তার পরে আমি আর জানি না।

এদিকে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ইনানের অনুসারী রাজিব বিশ্বাস দ্যা রিপোর্ট লাইভকে বলেন, সেখানে ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের সাথে হল ছাত্রলীগ নেতা গণেশের একটু ধাক্কা লাগে। গণেশ হল ছাত্রলীগের ইনানের অনুসারী। তাৎক্ষণিক সৈকতের কাছে মাফ চাইলে সৈকত ঘটনার মীমাংসা করে দেন। সৈকত ঘটনাস্থল ত্যাগ করলে তার অনুসারী সুস্ময়, অপূর্ব চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে আমাদের উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। এতে আমাদের প্রায় ছয় থেকে সাতজন আহত হয়।

এদিকে হামলার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অতনু বর্মণ। তিনি বলেন, আমার এবং সভাপতির ওপর যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কনসার্ট শেষে আমি এবং সভাপতি দুজন বাইরে খেতে গিয়েছিলাম। পরে হলে এসে দেখি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে। তবে আলাদাভাবে কোনো গ্রুপের ঝামেলা হয়নি। পরবর্তীতে আমি এবং সভাপতি কাজল দাসসহ প্রভোস্ট স্যার ঝামেলা মীমাংসা করে দেই।

ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, ‘মাতাল অবস্থায় গণেশ আমার গায়ের ওপর পড়লে আমি মীমাংসা করে দিয়ে চলে আসি। পরে জানতে পারলাম আমার গ্রুপের সাথে পূর্ব শত্রুতার জেরে হলের অন্যান্য কয়েকটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে তাদের ওপর হামলা করেছে। বাইরে থেকে কাদের ঢুকানো হয়েছে তাদের শনাক্ত করতে হবে।’

এ বিষয়ে জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, রাতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ৩-৪ জন আহত হয়েছে। আমি তাদের রাতেই দেখে এসেছি৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। হলেও ভাংচুর হয়েছে সাধারণত হামলায় যা যা হয়। একজন লাফ দিয়েছে। তাকেও দেখে এসেছি, সে আপাতত সুস্থ আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। হামলা মারামারি হয়েছে এমনটি আমি শুনিনি। তবে জানতে পেরেছি কিছু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু মারামারির বিষয়ে আমি এখনও শুনি নি। এমন কিছু হয়ে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিব।

এমন সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে আতঙ্কগ্রস্ত জগন্নাথ হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হলের এমন পরিস্থিতিতে খুবই আতঙ্কিত অবস্থায় আছি। গতকাল সারারাত হলের কেউ ঘুমাতে পারেনি। কখন যে কে কাকে মেরে দিবে এই নিশ্চয়তা নেই।’

Link copied!