শীতকালে উষ্ণ আবহাওয়া; বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

ডিসেম্বর ৭, ২০২৩, ০৪:৫৪ পিএম

শীতকালে উষ্ণ আবহাওয়া; বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

মোখা, হামুন, মিধিলি, সর্বশেষ মিগজাউম। ২০২৩ সালেই বঙ্গোপসাগরে চারটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেশি থাকলেও এ বছরে শীতকালে দুটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই দায়ী করছে আবহাওয়াবিদরা।

বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে গরম কালে , শীতকালে নেই শীতের ধরাছোঁয়া। অসময়ে বৃষ্টি এবং ঘূর্ণিঝড় সব মিলিয়ে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং এশিয়ার সবগুলো দেশ । তবে বাংলাদেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বাইরে নয় । 

এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুল হক দ্য রিপোর্টকে এক সাক্ষাৎকারে জানান, গত কয়েক বছর ধরে অসময়ে বৃষ্টিপাত ঘূর্ণিঝড় লেগেই আছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এর বড় কারণ। 

২০২৩ এর মে মাসে প্রথম ঘূর্ণিঝড় মোখাকে কেন্দ্র করে, ৮ মে একটা নিম্নচাপ সৃষ্টি করে সাগরে। ৯ মে ডিপ্রেশন সৃষ্টি, ১১ মে সাইক্লোন স্ট্রং এবং ১৪ মে বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে অতিক্রম করে। 

এরপর আরেকটা ঘূর্ণিঝড় আসে হামুন। অক্টোবরে মাসে। ২০ অক্টোবর পোস্ট মনসুন সিজনে এর উৎপত্তি হয়। প্রথমে নিম্নচাপ, ২২ অক্টোবর ডিপ্রেশন এবং সাইক্লোন স্ট্রং হয় ২৩ অক্টোবর। ২৪ অক্টোবর একইভাবে বাংলাদেশের উপকূলের অতিক্রম করে চলে যায়। 

সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রূপে মিধিলি বাংলাদেশ পটুয়াখালীর ক্ষেপু পাড়ার নিকট দিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে। এটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী ঘূর্ণিঝড় ছিল বলে জানায় আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর সময়কাল ১৭ নভেম্বর সকাল থেকে শুরু হয়ে ঐদিন বিকেল তিনটার দিকে বাংলাদেশ অতিক্রম করে। 

ফ্রিকোয়েন্স অফ ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা যে বাড়ছে এবং ২৮ নভেম্বর নাগাদ আরেকটা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় যার নাম মিগজাউম। এটি দক্ষিণ আন্দামান থেকে পর্যায়ক্রমে ঘনীভূত হয়ে ৩০ নভেম্বর নাগাদ ডিপ্রেশন এবং ৩-৪ ডিসেম্বর নাগাদ আঘাত হানার সম্ভাবনা দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে এর সময়কাল পার হয়ে ৬, ৭ ডিসেম্বর দুদিন নাগাদ হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হয় ।

এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুল হক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কাল থেকে যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে এটা থাকবে না। ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম ভারতের সাউথ অন্ধ্রপ্রদেশ এবং নর্থ তামিলনাডুর হয়ে ভারতের পাশ ঘেঁষে উড়িষ্যা, ওয়েস্ট বেঙ্গল হয়ে বাংলাদেশের ওপরে চলে আসছে। এজন্য মূলত বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটা সাইক্লোন হিসেবে না, ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম দুর্বল হয়ে নিম্নচাপ থেকে গভীর নিম্নচাপ এবং সুস্পষ্ট লঘুচাপ থেকে লঘুচাপ রূপে পরিণত হয়ে পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো দেশে বিরাজ করছে। মূলত এই লঘুচাপের ফলেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে আগামীকাল নাগাদ এই বৃষ্টিপাত কমে যাবে, এটা সাময়িক। এই বৃষ্টিপাতের ফলে তাপমাত্রা কিছুটা কমবে। রাতের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কিছুটা নেমে আসবে শীতের তীব্রতা খানিকটা বাড়লেও সেটা ক্ষণস্থায়ী কারণ রেইনিং কন্ডিশনের কারণে তাপমাত্রা শিথিল হবে। পরবর্তীতে এই তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হবে।’ 

মিগজাউমের দুর্যোগ কেটে নতুন করে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সাধারণত ডিসেম্বরর দশ তারিখ অবধি একটা সম্ভাবনা থাকে কিন্তু এখন যেহেতু দুর্যোগ কেটে গেছে। আগামী দশ দিন আর কোনো ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা নেই। যদি আগামী দশদিনে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো আভাস না থাকে তাহলে এই সিজনে আর ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা দেখছি না। কারণ এরপরই শীতের তীব্রতা খানিকটা বাড়বে। 

তবে এখন যে শীতের তাপমাত্রা কমবে এটা অস্থায়ী। কয়েকদিন পর এই তাপমাত্রা আবার বেড়ে একটা উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করবে। এটার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা দায়ী।’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

একই বছরে এত ঘূর্ণিঝড় হওয়ার কারণ সম্পর্কে পরিচালক আজিজুল হক বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। যার ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে , সমুদ্র পৃষ্ঠের সি সারফেসের তাপমাত্রা বাড়ছে। একটা ঘূর্ণিঝড় হতে হলে সি সারফেস তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে হতে হয় কিন্তু সেখানে দেখা যায় সমুদ্রের তাপমাত্রা প্রায় ২৮-২৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বিরাজ করে। তখনই এই লো প্রেশারগুলো সৃষ্টি হয় এবং সেখান থেকে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি।’

‘গত কয়েক বছরের তাপমাত্রার এ্যানামুলি যদি বিশ্লেষণ করা যায় তবে দেখা যায় আগে কখনো পজেটিভ এ্যানমুলি থাকতো কখনো নেগেটিভ এ্যানামুলি থাকতো। কিন্তু এখন যদি খেয়াল করা যায় তবে দেখা যায় পজেটিভ এ্যানামুলি অর্থাৎ তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। গড়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে । শুধু মাত্রা বিশ্বের তাপমাত্রা নয় সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।’ 

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক উদাহরণ হিসেবে আজিজুল হক বলেন, ‘এখন যে শীতকাল আসছে শীতকালের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যা থাকা দরকার তার থেকেও বেশি থাকছে তাপমাত্রা। গরমকালের তাপমাত্রা থেকে কিছুটা কমলেও শীত অনুপাতে তাপমাত্রা কমছে না। দিনে এবং রাতের তাপমাত্রা হিসাব করলে দেখা যায় রাতে তাপমাত্রা অনেকটা নিচে অবস্থান করলেও দিনে একটা উষ্ণ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। বলতে গেলে শীতকাল একটা উষ্ণতায় বিরাজ করছে। এগুলো সব মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের একটা বিরূপ প্রভাব বলা যেতে পারে। জলবায়ুর এই প্রভাব পুরো বিশ্বব্যাপী পড়ছে দক্ষিণ এশিয়া এবং এশিয়ার সবগুলো দেশেই এই প্রভাব পড়ছে। আমাদের দেশও দুর্যোগমুক্ত নয়, ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রতিক্রিয়া এখানেও থাকবে।’ 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আরও বলেন, ‘গতবছর জানুয়ারিতে কিন্তু প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, এটা একটা আনইউজুয়াল সিমটম। এগুলো সবকিছু কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে।’

সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি 

এ প্রসঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনেকটা বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সেক্ষেত্রে ফ্রিকোয়েন্সি অফ সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, হ্যাজার্ড, ডিজাস্টার সৃষ্টি হচ্ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে সমস্ত সাইক্লোন ফর্ম হয় সেগুলো সাধারণত বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হয়। ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রেও একইভাবে উপকূলে আঘাত হানে। ন্যাচারাল রিসোর্স আহরণের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্র থেকে তেল-কয়লা মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে সমুদ্রে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয় যার ফলে ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।

সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমানো এবং ঘূর্ণিঝড় রোধে করণীয়

আজিজুল হক মনে করেন, ন্যাচারাল রিসোর্স আহরণ কমানো এবং উপকূলীয় অঞ্চলে গাছ লাগানো উচিত। উপকূলীয় অঞ্চল দেশের ডিজাস্টার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, সাইক্লোন প্রিপার্ডনেস প্রোগ্রাম, লোকাল প্রশাসন যেহেতু উপকূলে তাই সেখানের নিয়মানুযায়ী কাজ করা উচিত । 

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়ন অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে বনায়ন শুধুমাত্র উপকূলীয় অঞ্চলে নয় বরং সারা দেশে বনায়ন করা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বনায়ন খুবই কার্যকরী। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেহেতু বাড়ছে ঘূর্ণিঝড় রোধ করা তো সম্ভব না তবে মোকাবিলা করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। 

Link copied!