মাঝেমধ্যে বুকে চাপ লাগত। ঘাড়, কাঁধে এবং পেটের উপরিভাগে ব্যথা এবং অস্বস্তিও অনুভব করতেন সঙ্গীতশিল্পী কেকে। গ্যাস-অম্বলের সমস্যা ভেবে তিনি হজমের ওষুধ খেতেন। সে ভাবে কখনও হৃদ্রোগ চিকিৎসকের পরামর্শও নেননি। বুধবার এসএসকেএম হাসপাতালে ময়না-তদন্তের সময়ে হাজির ওই শিল্পীর পরিবার এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ ও চিকিৎসকদের। তা শুনেই শহরের হৃদ্রোগ চিকিৎসকদের প্রশ্ন, ‘‘গ্যাসের সমস্যা ভেবে হৃদ্রোগের চিকিৎসা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা চলছেই। এর জন্যই কি পরবর্তী সময়ে বড় বিপদ এড়ানো যাচ্ছে না?’’
কেকে-র মৃত্যু আবারও সেই প্রশ্নই তুলে দিল। হৃদ্রোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অধিকাংশ মানুষই ভাবতে চান না যে, তাঁর হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা রয়েছে। তাই বুকে চাপ বা অন্য কোনও সমস্যাকে গ্যাস-অম্বল ভেবে লাগাতার হজমের ওষুধ খেয়ে চলেন। হৃদ্রোগ চিকিৎসক ধীমান কাহালির কথায়, ‘‘সবার প্রথমে ভ্রান্ত ভাবনা পাল্টানো প্রয়োজন। কারণ, হৃদ্রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছনোর আগে এক বা একাধিক সঙ্কেত অবশ্যই দেয়।’’ চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, আচমকা বুকেচাপ ও শরীরে অস্বস্তি, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট, প্রচুর ঘামকে সাধারণ সমস্যা ভাবা মানেই ‘গোল্ডেন আওয়ার্স’-কে নষ্ট করা। অর্থাৎ, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার এই সব লক্ষণ দেখা দিলে, প্রথম এক ঘণ্টায় চিকিৎসা শুরুকরা উচিত। তা হলেই বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব হবে।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, ওই শিল্পীকে প্রায় দু’ঘণ্টা পরে যখন সিএমআরআই-তে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাঁর নাড়ির গতি বা রক্তচাপ কিছুই পাওয়া যায়নি। ইসিজি-তে হৃদ্স্পন্দন সরলরেখা হয়ে গিয়েছিল। জানা যাচ্ছে, গত ৩০ মে সোমবার কলকাতায় পৌঁছনোর দিনেও কাঁধ ও বুকে ব্যথা অনুভব করেছিলেন কেকে। তার পরেও মঙ্গলবার মঞ্চে তাঁর হাঁটাচলার ছন্দে সমস্যা, বার বার ঘাম মোছার দরকার, অস্বস্তি, হোটেলে ফেরার সময়ে শীত ভাব হয়। এই সব লক্ষণ শুনেই সংশয় চিকিৎসক ধীমান কাহালির। তিনি বলছেন, ‘‘এগুলি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। কলকাতায় আসার পরে কিংবা মঙ্গলবার অনুষ্ঠানে যখন শারীরিক অস্বস্তি বোধ করছিলেন, তখন বিরতিতে চিকিৎসককে দেখালে হয়তো বড় বিপদ এড়ানো যেত।’’
এসএসকেএমের হৃদ্রোগ চিকিৎসক সরোজ মণ্ডল জানাচ্ছেন, এক ধরনের হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ গ্যাস-অম্বলের উপসর্গের মতো হয়। মানুষ ভাবেন, হজমের ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়ে গেলেন। কিন্তু তেমনটা একেবারেই নয়। বরং কিছু ক্ষণ বিশ্রামের কারণে আপাতত স্বস্তি মিললেও, অলক্ষ্যেই হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা বাড়তে থাকে। দীর্ঘ দিনের এই সমস্যার সঙ্গে মানসিক চাপ বাড়তি ঝুঁকিতৈরি করে।
সরোজ বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন সমস্যা উপেক্ষা করায় রক্তনালি ক্রমশ সঙ্কুচিত হলেও, বোঝা যায় না। আচমকাই স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে হৃৎপিণ্ডে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহব্যাহত হয়। তখন মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হয়ে ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদ্মিয়া হতে পারে, অর্থাৎ, হৃদ্যন্ত্রের গতি মারাত্মক ভাবে বেড়ে আচমকাই তা স্তব্ধ হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শক্ দেওয়া প্রয়োজন।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, যাঁদের পরিবারে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে, তাঁদের কুড়ি বছর বয়স হলেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর হৃদ্যন্ত্র এবং রক্তের কিছু পরীক্ষাকরা প্রয়োজন।
আবার, কোভিড পরবর্তী সময়ে রক্তনালির প্রাচীরে ক্ষত হওয়ার সমস্যা অনেক বেড়েছে বলেও জানাচ্ছেন হৃদ্রোগ চিকিৎসক শুভানন রায়। তাঁর কথায়, ‘‘গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই সমস্যা এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। তাই সামান্য সমস্যাকেও অবহেলা করা ঠিক নয়। আর প্রচণ্ড ঘাম, অস্বস্তি হলেও শিল্পী ভাবলেন নাতাঁর হার্টের সমস্যা হতে পারে। মানুষ এই উপেক্ষার প্রবণতা ছাড়তে না পারলে হার্ট সংক্রান্ত বড় বিপদ এড়ানো যাবে না।’’