সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২, ০৭:৩৭ পিএম
মাত্র এক বছর আগেই ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হবার দৌড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলেন দেশটির অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক। অন্যদিকে, আর লিজ ট্রাস ছিলেন অনেকটাই পিছিয়ে।
অথচ, মাত্র একমাসের প্রচারণার পরই কনজারভেটিভদের নেতা নির্বাচনের ফলাফল অভাবনীয়ভাবে পাল্টে গেল। লিজ ট্রাস হলেন নতুন নেতা, একই সাথে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনের ফলাফল এমনটাই হবে বলেই ধারণা করছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ট্রাসের এই বিজয় মোটেই অনভিপ্রেত নয়।
বরিস জনসন ইস্তফা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই, ঋষি সুনাকই প্রথম পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নিজের প্রার্থিত ঘোষণা করেছিলেন। অন্যদিকে, শেষ প্রার্থী হিসেবে এই দৌড়ে যোগ দিয়েছিলেন লিজ। প্রথম কয়েক রাউন্ডে সবার আগে ছিলেন সুনাকই। কিন্তু যত দিন গিয়েছে ততই ঋষির জনপ্রিয়তা কমেছে, আর পথ পরিষ্কার হয়েছে লিজ ট্রাসের। কিন্তু, কেন প্রথম থেকে এগিয়ে থেকেও, শেষ রাউন্ডে এসে পরাজিত হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনাক?
নির্বাচনের সময় পরিচালিত সব সমীক্ষায় সমীক্ষায়, লিজ ট্রাস ঋষি সুনাকের থেকে এগিয়েই ছিলেন। বিবিসি, রয়টার্সসহ ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বর্তমান নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস নিজের দলের মধ্যেও সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি সরব থাকা ট্রাস বরিস জনসনের অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবেও পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, যখন দলের অনেক নেতা বরিস জনসনের বিরোধিতা করে পদত্যাগ করছিলেন, তখন লিজ ট্রাস তাঁর সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন।
মত পার্থক্যের জন্য বিরিস জনসন সরকার থেকে ঋষি সুনাক আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করেন। কিন্তু লিজ ট্রাস অনুগত ছিলেন। পদত্যাগ করে বরিসকে ছেড়ে যান নি। বলা হচ্ছে, দলে যারা বরিস জনসনকে সমর্থন করেন, তারা বিপুল উৎসাহে লিজ ট্রাসকে ভোট দিয়েছেন। আর এ কারণে ঋষি সুনাক পিছিয়ে গেছেন বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
আবার লিজ ট্রাসের নির্বাচনী কৌশল তাকে ঋষি সুনাকের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন অনেকে। লিজ ট্রাস তার নির্বাচনী প্রচারে হাতিয়ার করেছেন ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি। নির্বাচনে জিতলে ১.২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর কমিয়ে দেবেন বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ট্যাক্স কাট এমন একটি প্রতিশ্রুতি যা প্রতিটি দেশের মানুষই পছন্দ করেন এবং সময়ে সময়ে প্রলুব্ধ করেন।
বরিস তার শাসনকালে বিতর্কের মুখে থাকলেও দলে খুবেই জনপ্রিয়তা আছে। তাছাড়া, লিজ ট্রাসকে ভোট দিতে বলেছেন সবাইকে। মূলত ঋষি সুনাক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হোক তা তিনি চাননি। তাই লিজ ট্রাসকে জেতানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। ঋষি সুনাককে প্রধানমন্ত্রী হতে দেখতে পারবেন না বরিস, তা আগেই জানিয়েছিলেন। দলে বরিস জনসনের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে ঋষি বরিসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
অনেকেই বলছেন, সম্ভবত তাঁর ভারতীয় স্ত্রী অক্ষতাই তাঁর পতনের আর একটি কারণ। সানডে টাইমসের ধনী তালিকা অনুসারে, অক্ষতা মূর্তি ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের থেকেও ধনী। গত মাসে লেবার পার্টি ঋষি সুনাকের ব্যবসার তহবিল সংগ্রহের জন্য ঋণ গ্রহণের বিষয়ে আরও স্বচ্ছতার দাবি করেছিল। তারপরই এই দম্পতির সম্পত্তি নিয়ে কাঁটাছেঁড়া শুরু হয়। অক্ষতা মূর্তি ইনফোসিস সংস্থার ০.৯৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক, যার মূল্য ৬৯ কোটি ইউরো। এদিকে, অক্ষতা এখনও ভারতীয় নাগরিক। যুক্তরাজ্যে আবাসিক না হওয়ায় তিনি যুক্তরাজ্যে কর দিতে দায়বদ্ধ নন। তাই গত বছর তিনি প্রায় ২ কোটি পাউন্ড কর বাঁচাতে পেরেছেন। ফলে ঋষির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি গরিবদের থেকে কর নিচ্ছেন। অথচ, যেখানে তাঁর স্ত্রীই কর দেন না।
বরিস জনসনের পদত্যাগ করার পিছনে সবথেকে বড় ভূমিকা ছিল ঋষি সুনাকেরই। চ্যান্সেলর পদ থেকে সুনাকের ইস্তফার পরই একযোগে বরিস সরকারের সাংসদরা নিজ নিজ পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। পতন ঘটেছিল বরিস জনসন সরকারের। এই ঘটনার পর থেকে তাঁর প্রতি অবিশ্বাস কাজ করেছিল কনজ়ারভেটিভ পার্টির সদস্যদের মনে। যে কারণে, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে অনেকেই অনিচ্ছুক ছিলেন।
অন্যদিকে কেন্ট কমিউটার বেল্ট’ প্রকল্পের জন্য ‘বঞ্চিত শহুরে এলাকা’ থেকে অর্থ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন ঋষি। এতেই ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। এর আগে যুক্তরাজ্য সরকার ব্রিটেনে অর্থনৈতিক সাম্য আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর জন্য দক্ষিণ-পূর্ব ব্রিটেনের বাইরে সম্পদ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। ঋষি সুনাকের পদক্ষেপ সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বলে মনে করেছেন কনজ়ারভেটিভ পার্টির সদস্যরা।
গ্রিনকার্ড রেখে দেওয়াও হারের পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে। চ্যান্সেলর হওয়ার পরও ১৮ মাস ধরে গ্রিন কার্ড ধরে রেখেছিলেন ঋষি সুনাক। পরে আমেরিকায় তার প্রথম সরকারী সফরের সময়, ২০২১ সালে তিনি ওই কার্ড ছেড়ে দেন। ব্রিটেন দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি দিলেও, এই ঘটনা কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষে ছিল ক্ষতিকর। গ্রিন কার্ড থাকার কারণে ব্রিটেন নিয়ে সুনাকের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে।