ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ জন্ম দিলো ইসরায়েল-জাতিসংঘ দ্বন্দ্বের

আল জাজিরা

অক্টোবর ২৬, ২০২৩, ০৭:৩২ এএম

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ জন্ম দিলো ইসরায়েল-জাতিসংঘ দ্বন্দ্বের

ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত গাজা। ছবি: রয়টার্স।

ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যে চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের কর্মীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার। আন্তোনিও গুতেরেসের পদত্যাগ দাবি করে তেল আবিব আরও হুমকি দিয়েছে, জাতিসংঘকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার সময় এসেছে এবার।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইসরায়েলে ভয়ংকর এক হামলা চালিয়েছে হামাস। তবে এ হামলা যে হঠাৎ শূন্য থেকে (কারণ ছাড়া) হয়নি, এটাও সবাইকে বুঝতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার।

তাঁরা তাঁদের ভূখণ্ড দখল করে অবৈধ ইহুদি বসতি দেখেছেন। তাঁরা সহিংসতায় জর্জরিত হয়ে চলেছেন।

জাতিসংঘপ্রধান আরও বলেন, গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা যেমন হামাসের ভয়ংকর হামলার ন্যায্যতা দিতে পারে না, তেমনি আবার এ হামলার জেরে জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণকে শাস্তি দেওয়া কখনো ন্যায্যতা পেতে পারে না।

আন্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্যের পরপরই ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানায় ইসরায়েল। গুতেরেসের এ মন্তব্যের পর সেদিনই তাঁর পদত্যাগ দাবি করে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলার্ড এরডান। তিনি বলেন, গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নন। তাঁর পদত্যাগ করা উচিত। গতকাল বুধবার তিনি বলেছেন, জাতিসংঘের কর্মীদের ইসরায়েলের ভিসা দেওয়া হবে না।

ইসরায়েলের এক সংবাদমাধ্যমকে এরডান বলেন, ‘তাঁর (গুতেরেস) বক্তব্যের কারণে আমরা জাতিসংঘের কর্মীদের ভিসা দেব না। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণসহায়তাবিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথসকে ভিসা দিইনি। তাদের (জাতিসংঘ) উচিত শিক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে।’

গিলার্ড এরডান এক্স–এ (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ইসরায়েলের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়ংকর হামলার পেছনেও যাঁরা যুক্তি দেখাতে চান, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার কোনো ধরনের যৌক্তিকতাই নেই।

পরে অবশ্য জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, তাঁর বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি পরিষ্কারভাবে হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেনের। তবে জাতিসংঘপ্রধানের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন তিনি।

২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যু
এত কিছুর মধ্যেও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণ থেমে নেই। গাজায় হামলার ১৯তম দিনে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে গাজা। গতকাল বিকেলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় আরও ৭৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪৪টিই শিশু। ৭ অক্টোবরের পর গাজায় হামলা শুরুর পর এটিই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন।

ইসরায়েলে গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের হামলার পর গত প্রায় তিন সপ্তাহে গাজায় মোট ৬ হাজার ৫৪৬ জন প্রাণ হারালেন। তাঁদের মধ্যে শিশু ২ হাজার ৭০৪ এবং নারী ১ হাজার ৫৮৪ জন। নিহত ব্যক্তিদের তিন ভাগের দুই ভাগ নারী ও শিশু। সাত শতাধিক শিশুসহ নিখোঁজ দেড় হাজারের বেশি। আহত ১৭ হাজার ৪৩৯।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলি হামলার তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। প্রথমদিকে বোমা হামলায় প্রতিদিন গড়ে ২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছিলেন। এ সপ্তাহের শুরুতে গড়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০০ জনে। গত দুই দিনে গড়ে ৭ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য গতকাল আবারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে সহিংসতা বন্ধে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব। আরব বিশ্বের পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও পশ্চিমা দেশগুলো এখনো ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা চালানোর অনড় অবস্থানের পক্ষে।

খাবার নেই, বন্ধ হাসপাতাল
গাজায় খাবার ও পানির তীব্র হাহাকার চলছে। আগে থেকেই নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা গাজার বাসিন্দাদের অনেকের এখন অনাহার–অর্ধাহারে দিন কাটছে। জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজার অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। সামান্য ত্রাণসহায়তায় নির্ভরশীল তাঁরা। দাতব্য সংস্থাগুলোর দেওয়া খাবারের জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে গাজাজুড়ে। সংস্থাগুলো বলছে, তাদের কাছে যে খাবার আছে, তা দিয়ে এতসংখ্যক মানুষের চাহিদা মিটছে না।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, গাজাবাসীর বিরুদ্ধে অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে খাদ্য বন্ধ করে দেওয়াকে কোনোভাবেই বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই।

অব্যাহত বোমাবর্ষণে ক্ষতির শিকার হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি, ওষুধ ও চিকিৎসক–স্বাস্থ্যকর্মীসংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাজার হাসপাতাল। এতে করে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থায় চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

প্রতিনিয়ত বোমা হামলায় শত শত মানুষ হতাহত হচ্ছেন। তাঁদের অনেককে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শুধু সংকটাপন্ন রোগীদের সেবা দিতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

জাতিসংঘ গতকাল জানিয়েছে, বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং জ্বালানিসহ অন্যান্য সংকটে গাজার ৩৫টি হাসপাতালের ১২টিতে এখন সেবাদান বন্ধ আছে। আর ৭২টির মধ্যে ৪৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও বন্ধ।

‘মৃত্যুর পর যেন চিনতে পারি’
গাজার বাসিন্দা আলী ও লিনা দম্পতির সাত সন্তান। ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলার মুখে বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে পরিবারটি। তবে বাড়ি ছাড়ার আগে আলী সিদ্ধান্ত নেন, যেখানেই যাবেন একসঙ্গে থাকবেন না সবাই। কারণ, একসঙ্গে থাকলে এক হামলায় সবার মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে যায়।

দুই ছেলে, দুই মেয়েসহ স্ত্রী লিনাকে গাজার উত্তরাঞ্চলে পাঠিয়েছেন আলী। তিন সন্তানসহ তিনি আছেন গাজার দক্ষিণের খান ইউনিসে। আলী বলেন, স্ত্রী ও সন্তানদের সবার দুই হাতে নীল ফিতা বেঁধে দিয়েছেন। বললেন, ‘মৃত্যুর পর যেন তাঁদের দেখে চিনতে পারি।’

শুধু আলী-লিনা দম্পতি নন, গাজার বাসিন্দাদের সবারই দিন কাটছে এমন আতঙ্কে। ইতিমধ্যে গাজার অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। খাবার ও পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলি অবরোধের কারণে প্রয়োজনীয় ত্রাণও পৌঁছানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সৌজন্য: প্রথম আলো

Link copied!