গল্পের আড়ালে থাকে অনেক অপ্রকাশিত গল্প। ইতিহাসের পিছনে থাকে হারিয়ে যাওয়া বা ইচ্ছে করেই না প্রকাশ করা অনেক ইতিহাস। তেমনই সামনে যাদের দেখছেন তাদের আড়ালে কলকাঠি নাড়ছেও অন্য কেউ।
বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতির ইতিহাসের পিছনে কলকাঠি নাড়া এক পরিবারের কথাই আপনাদের জানাব আজ।
অনেকে হয়তো তাদের নাম শুনেছেন আবার অনেকের কাছে আজও অজানা বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে যাওয়া এই পরিবারের কথা।
বলছি রথসচাইল্ড পরিবারের কথা। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবার রথসচাইল্ড পরিবার। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যাংকিং সিস্টেমের পুরোটাই ছিল এই পরিবারের হাতে। সে সময় চলমান যুদ্ধও প্রভাবিত হয়েছিল তাদের দ্বারা।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ফ্রান্সের ও ব্রিটেনের মধ্যে ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ সালে যে যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধেও কলকাঠি নেড়েছিল এই পরিবার। এমনকি বলা হয় ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটির জন্মের পিছনেও ছিল এই ধনাঢ্য ইহুদি পরিবারের হাত।
রথসচাইল্ড পরিবারের এই বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যের কাণ্ডারি জার্মানির এক ইহুদি পরিবারের সন্তান মায়ার আমশেল রথসচাইল্ড। বাবা ছিলেন প্রাচীন শিল্প সামগ্রী কেনাবেচা ও সিল্ক কাপড়ের ব্যবসায়ী। মায়ারের বয়স যখন ১২, গুটিবসন্তে মৃত্যু হয় তার বাবা-মায়ের। সেই বয়সেই একটি ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এর সাথে বিরল মুদ্রা সংগ্রহ করাও শুরু করেন মায়ার। ১৯ বছর বয়সে বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে নেন আর ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে খুলে বসেন একটি ব্যাংক। ইহুদিদের টাকা জমা রাখা-ধার দেয়া, চড়া সুদের ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খুব দ্রুতই ধনসম্পদ বাড়তে থাকে তার।
সে সময় ব্যবসার সূত্র ধরেই মায়ারের সাথে পরিচয় হয় হেসে-কাসেলের রাজপরিবারের সাথে। রাজপরিবারে আনাগোনা ও সমাজের ধনাঢ্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে নিজের ব্যবসা আরও বাড়িয়ে তোলেন। বিয়ে করেন ভালো বংশে। পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে সন্তান হয় তাঁর। আর পরবর্তীতে পাঁচ ছেলে আমসেল, সালমন, নাথন, কার্ল ও জ্যাকবকে দিয়েই বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং ব্যবসার রাজত্ব গড়ে তোলেন মায়ার।
ফরাসি বিপ্লবের সময় মার্চেন্ট ব্যাংক খোলার জন্য এক ছেলেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে রেখে বাকি চারজনকে পাঠিয়ে দেন ইউরোপের চার সমৃদ্ধ শহর নেপলস, প্যারিস, ভিয়েনা ও লন্ডনে। ব্যবসা আরও বড় হয়। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী পরিবারে পরিণত হয় রথসচাইল্ড পরিবার।
শুরুতে যে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের যুদ্ধের কথা বলেছিলাম সেই যুদ্ধে প্রভাব ফেলার ঘটনা এই সময়ই ঘটে। নেপোলিয়নের হাত থেকে বাঁচাতে হেসে-কাসেলের রাজা উইলিয়াম মায়ারের কাছে বিশাল পরিমাণ অর্থ জমা করেন। আর মায়ার তার তৃতীয় পুত্র লন্ডনে ব্যাঙ্কার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নাথানের সেই অর্থ পাঠিয়ে দেন। তারপর লন্ডনে যাত্রা শুরু করে ‘এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি অর্থলগ্নি সংস্থা।
এক দশক ধরে চলা এই যুদ্ধে যখন ব্রিটেনের অর্থনীতির অবস্থা করুণ সে সময় মায়ারপুত্র নাথান ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জকে ধার দেন ৯.৮ মিলিয়ন পাউন্ড। যে টাকাটা ছিল হেসে-কাসেলের রাজা উইলিয়ামের। নতুন করে ফ্রান্স-ব্রিটেন যুদ্ধ জমে উঠলো আর ব্রিটেন রাজপরিবারেরও প্রিয় মুখ হয়ে গেলেন নাথান রথসচাইল্ড।
যুদ্ধ চলার মাঝেই আরও একটি দারুণ চাল চেলেছিলেন নাথান। যে চাল দিয়ে এক দিনে তিনি কামিয়েছিলেন ১৩০ মিলিয়ন পাউন্ড। ব্রিটেনের রাজাকে দিয়ে বাজারে ‘ওয়ার বন্ড’ ছাড়েন। নিজেও কেনেন সেসব বন্ড। ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটারলুর যুদ্ধে যখন নেপোলিয়নের পরাজয় হয় সে খবর ব্রিটেনের রাজার আগে নাথানের কানে আসে। আর সেই খবর শুনেই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই নৌকায় রাতের বেলা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে লন্ডনে আসেন নাথান। কম দামে বেচে দিতে থাকেন ওয়ার বন্ডগুলো।
যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয় আসন্ন ভেবে অন্যরাও বন্ড বেচে দিতে থাকে জলের দরে। সেই সময় সব বন্ড কিনে নেন নাথান ও তাঁর চার ভাই। এমনকি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় নাথানের ব্যাংক। সেদিনই সন্ধ্যায় লন্ডনে আসে ওয়াটারলু যুদ্ধ জয়ের সংবাদ। আর উল্কাগতিতে বেড়ে যায় বন্ডের দাম। সে সময় আকাশছোঁয়া দামে বন্ডগুলো বিক্রি করে একদিনে ১৩০ মিলিয়ন পাউন্ড কামিয়ে নেয় রথসচাইল্ডরা।
শুধু তাই নয়, যুদ্ধের সময় ব্রিটেনের রাজাকে দেয়া অর্থ চড়া সুদসহ ফেরত নেন নাথান। হেসে-কাসেলের রাজা উইলিয়াম তার বাবা মায়ারকে যে টাকা দিয়েছিল সেটিও ফেরত দেন। এর মাঝে বিপুল অর্থ আয় করে ব্রিটেনের রাজপরিবারের থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন নাথান। ওই যুদ্ধে ধার করা অর্থ ২০০ বছর ধরে রথসচাইল্ড পরিবারকে পরিশোধ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার।
এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারকে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া শুরু করেছিলেন নাথান ও তাঁর চার ভাই। প্রজা বিক্ষোভে সম্পত্তি বেদখল হওয়ার ভয়ে রথসচাইল্ড পরিবারের কাছে নগদ অর্থ জমা রাখতে শুরু করেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শাসকেরা। ব্রিটেনে ‘ব্যারন’ ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যারনের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল মেয়ার রথসচাইল্ডের পাঁচ ছেলেকে। এক কথায় ইউরোপের খ্রিস্টান দেশগুলোর অর্থনীতি সম্পূর্ণ নিজের মুঠোয় নিয়ে আসে ইহুদি ‘রথসচাইল্ড’ পরিবার।
এরপর রথসচাইল্ডদের চোখ যায় আমেরিকার দিকে। ১৮১২ সালের ব্রিটেন-আমেরিকা যুদ্ধের পিছনে নাথান রথসচাইল্ডের প্ররোচনা ও অর্থ ছিল বলে জানা যায়। আবার যুদ্ধ শেষে আমেরিকার অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংককে টাকা দিয়েছিলেন এই নাথান রথসচাইল্ডই।
এছাড়াও রাশিয়া-জাপান যুদ্ধের (১৯০৪-০৫) সময়েও জাপানকে বিপুল অর্থ ধার দিয়েছিল রথসচাইল্ড পরিবার। সে সময়ও যুদ্ধের বন্ড ছেড়ে তারা কামিয়ে নিয়েছিল কোটি কোটি ডলার।
শুধু তাই নয়, ব্রাজিল, জিম্বাবুয়ে ও ইসরায়েলের স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পিছনেও রয়েছে রথসচাইল্ড পরিবারের অর্থায়ন।
একটা সময় বিশ্বের সমস্ত বড় আর্থিক লেনদেন হতে শুরু করে রথসচাইল্ডদের হাত দিয়েই। তাদের হাজার হাজার এজেন্ট ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ক ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে। কিনে নেয় লোকসানে চলতে থাকা ব্যাঙ্কগুলো। এভাবেই বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে নেয় নিজেদের দখলে আর শাসকের আসনে বসায় নিজেদের পছন্দের সরকার।
পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকেও প্রচুর টাকা কামিয়ে নিয়েছিল রথসচাইল্ডরা। দুই পক্ষকেই যুদ্ধে লড়তে চড়া সুদে ঋণ দেয় তারা। আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য আরও ঋণ দেয়। এভাবে ঋণের চক্রে ফেঁসে যায় দেশগুলো আর রথসচাইল্ডদের হাতের মুঠোয় বন্দি হয়ে যায়।
রথসচাইল্ড পরিবারটিকে আরও বেশি রহস্যময় করে রাখে তাদের জীবনযাত্রা। সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠান ছাড়া ক্যামেরার সামনে খুব কমই দেখা যায় তাদের। এমনকি তাদের কর্মচারীদেরও বাছাই করা হয় অনেক সাবধানে। বংশানুক্রমে তাদের জন্য কাজ করে আসছে এসব কর্মচারীরা।
রথসচাইল্ড পরিবারের এই সাম্রাজ্য যিনি গড়েছিলেন সেই মায়ার আমশেল রথসচাইল্ড ১৮১২ সালে মারা যান। তিনি মৃত্যুর আগে অদ্ভুত এক শর্ত রেখে যান। মায়ার উইলে লেখেন, বাইরের কেউ পরিবারের ব্যবসায় ঢুকতে পারবে না এবং পরিবারের বড় ছেলেই থাকবেন প্রধান হিসেবে। সন্তানদের বিয়েও হবে নিজেদের বংশের মধ্যেই যেন নিজেদের অর্থসম্পত্তি বাইরে না যায়। আর ব্যবসার কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা অংশ নেবে না।
এখনো ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে মেয়েদের অনুমতি নেই। তারা সমাজসেবামূলক কাজগুলো দেখে থাকে। আর বংশের বাইরে বিয়ে শুরু হলেও ইহুদি হওয়া বাধ্যতামূলক। বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হলেও ব্যবসাখাতে তাদের জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
আজও বিশ্ব অর্থনীতি রথসচাইল্ডদের নিয়ন্ত্রণে আছে। সপ্তম প্রজন্মে পা রাখা এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা বর্তমানে পাঁচশো প্রায়। বর্তমানে রথসচাইল্ড পরিবারের সপ্তম পুরুষদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত রথসচাইল্ড হলেন, ৩৮ বছরের আলেকজান্দ্রে রথসচাইল্ড। যিনি বর্তমানে রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্সের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান।
অ্যাপল, মেটা, অ্যামাজনসহ বিখ্যাত কোম্পানিগুলোতে তাদের অর্থ বিনিয়োগ করা আছে। ব্যাংক ছাড়াও রিয়েল এস্টেট, শিপিং কোম্পানি, হোটেল বিজনেস ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে গেছে রথসচাইল্ডদের ব্যবসা। ব্যবসার পাশাপাশি রথসচাইল্ডদের অর্থে গড়ে উঠেছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ইহুদি হয়েও খ্রিস্টানদের পবিত্র ভ্যাটিকান সিটিকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের অনুদান দেয় পরিবারটি।
তবে রথসচাইল্ড সাম্রাজ্যর দুশোরও বেশি সময় পেরিয়েছে। মায়ারের উইল এবং পাঁচ পুত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া ব্যবসায়ও এসেছে পরিবর্তন। অর্থ সম্পদ ভাগ হয়েছে উত্তরাধিকারদের মধ্যে। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে রথসচাইল্ডদের অনেক ব্যাংক। এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী পরিবারটির বর্তমান অবস্থা এমনই যে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস–এর বিশ্বের প্রথম ৫০০ ধনী ব্যক্তির মধ্যে ‘রথসচাইল্ড’ পরিবারের একজনও নেই।