গাজীপুরে যে শিক্ষক দম্পত্তির মৃত্যুর ঘটনা থ্রিলার সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেম্বর ৪, ২০২২, ০৮:০৪ পিএম

গাজীপুরে যে শিক্ষক দম্পত্তির মৃত্যুর ঘটনা থ্রিলার সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে

গাজীপুরের এক শিক্ষক দম্পত্তির মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে ব্যবহার করা হয়েছে বিড়াল! মাস দুয়েক আগে ওই শিক্ষক দম্পতিকে তাঁদের পাইভেট কারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, একেবারে অক্ষত অবস্থায়! এরপর এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তের কাজে ব্যবহার করা হয় একটি বিড়াল। এরপরই পুলিশ দাবি করে, ওই মৃত্যু ঘটেছে গাড়িতে বিষাক্ত গ্যাসের কারণে! বিষয়টি নিয়ে এখন এলাকায় চাঞ্চল্য বিরাজ করছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, ওই শিক্ষক দম্পতির ব্যবহৃত গাড়িতে একটি বিড়াল রেখে এসি ছেড়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১০ থেকে ১২ মিনিট পর বিড়ালটি দুর্বল হয়ে ন্যুয়ে পড়তে থাকে। ঠিক ২৫ থেকে ২৬ মিনিট পর বিড়ালটি মারাও যায়। শিক্ষক দম্পত্তিও স্কুল থেকে রওনা দেয়ার পর যে স্থান থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয় সেই দুরত্বটিও ছিলো অনুমানিক একই সময়ের। এই পরীক্ষা থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষক দম্পত্তির মৃত্যু বিষাক্ত গ্যাস থেকে হয়েছে। এখন ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষা করছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার বিকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গাছা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাদির উজ্জ -জামান গণমাধ্যমকে এসব কথা জানিয়ে বলেছেন, এখন জব্দ করা আলমতের পরীক্ষা-নিরিক্ষা চলছে।

তবে পুলিশের এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয় মামলার বাদি নিহত স্কুল শিক্ষক জিয়াউর রহমানের বড় ভাই স্কুল শিক্ষক আতিকুর রহমান ও তাঁর স্বজনরা। মামলার বাদি আতিক বলেন, পুলিশের এটি মনগড়া কথাবার্তা। পুলিশের ওই ‘বিড়াল ব্যাখ্যার’ কোনো ভিত্তি নেই। আমরা তাঁদের যুক্তি কোনোভাবেই মানতে পারছি না। পুলিশ তাদের তদন্ত সঠিক ভাবে করতে না পারায় এমন ব্যখ্যা দিচ্ছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের খাইলকুর এলাকা গত ১৮ আগষ্ট ভোরে তাঁদের প্রাইভেট কার থেকে শিক্ষক দম্পতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁদের মুখ দিয়ে সামান্য লালা বের হওয়া ছাড়া আর কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিলো না। গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি, র‌্যাব-১ সহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাটি তদন্ত করে আসছে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি তাঁরা।

গত ১৭ আগষ্ট গাজীপুরের কামাড়জুরী এলাকার বাসিন্দা গাজীপুর টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম জিয়াউর রহমান (৫১) তাঁর স্ত্রী টঙ্গীর আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মাহমুদা আক্তার জলি (৩৫) স্কুলে গিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে নিখোঁজ হন। পরদিন ১৮ আগষ্ট ভোরে তাঁদের ব্যবহৃত প্রাইভেট কার থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনার একদিন পর নিহতের বড় ভাই স্কুল শিক্ষক আতিকুর রহমান বাদি হয়ে আজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে ঘটনার দুই মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ঘটনার ক্লু খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। পাওয়া যায়নি ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা প্রতিবেদনও।

গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মো. শাফি মোহাইমেন বলেন, এখন পর্যন্ত নিহতদের ভিসেরা প্রতিবেদন আসেনি। যার কারণে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনও দেয়া হয়নি। প্রতিবেদন কবে আসবে সেটিও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

গাছা থানা পুলিশ জানায়, থানা পুলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন তথ্য উপত্য ও আলামত সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু কোথাও কোনো ধরনের ক্লু পাওয়া যায়নি।

এরই মধ্যে গাছা থানায় ইব্রাহীম হোসেন নামের এক নতুন ওসি যোগদান করেন। তিনি এসময় সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর মামলার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু দিন আগে গাড়িতে একটি বিড়াল রেখে পরীক্ষা করা হয়।

গাড়িতে বিড়ালটি রেখে এসি ছেড়ে বন্ধ করে দেওয়া হলে ১০ থেকে ১২ মিনিট পর বিড়ালটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ২৫ থেকে ২৬ মিনিট পর বিড়ালটি মারাও যায়। পরে পুলিশ গাড়ির ও গাড়ির ভিতরে থাকা বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে তা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বিআরটিএ, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সসহ আরও কয়েকটি সংস্থায় পাঠায়। এ ছাড়া ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায়ও রয়েছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা।

গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইব্রাহীম হোসেন বলেন, আমরা এখনই সবকিছু প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেলেই বিষয়টি আমরা আরও নিশ্চিত হতে পারবো।

পুলিশ ও স্বজনরা জানায়, শিক্ষক দম্পত্তি জিয়াউর রহমান ও মাহমুদা আক্তারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টঙ্গীর পাশাপাশি এলাকায়। যার কারণে প্রতিদিন তাঁদের প্রাইভেটকার নিয়ে একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। গাড়িটি জিয়াউর রহমান নিজেই চালাতেন।

গত ১৭ আগষ্ট সকালে তারা স্কুলে যান এবং কাজ শেষে সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে বের হয়ে আর বাসায় ফিরে আসেননি। পরদিন ১৮ আগষ্ট ভোরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ খাইকুর এলাকা থেকে তাঁদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গাড়িতে বিড়াল রেখে পরীক্ষার পর প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি তাঁদের মৃত্যু বিষাক্ত এসির গ্যাস থেকেই হয়েছে। বিড়াল দিয়ে পরীক্ষার পর গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও এসির গ্যাস পরীক্ষার জন্য বিআরটি ও সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন এলে আমরা আরও নিশ্চিত হতে পারবো। তখন সবকিছু বলা যাবে।

Link copied!