বঙ্গবন্ধু যেখানে অনন্য অসাধারণ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ১৭, ২০২১, ১১:২৬ পিএম

বঙ্গবন্ধু যেখানে অনন্য অসাধারণ

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়তে গেলে ইতিহাসের পরতে পরতে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়! তার লেখা দুটি বই আছে, অটোবায়োগ্রাফি। সেখানে তিনি ঐতিহাসিক পরম্পরা তুলে ধরেছেন। সেখানে বিন্দুমাত্রও ‘‘আমি দেশ-জনগণের জন্য এই কইরা ফেলছি, সে-ই কইরা ফেলছি’’ ধরণের কোনো বাক্য নেই! অথচ তিনি যদি ওভাবে লিখতেনও, অতিশয়োক্তি হতো না। কিন্তু লেখেননি তিনি।

তিনি দেশ, দেশের মানুষ এবং স্বাধিকার তথা মুক্তির জন্য সবই করেছেন। জীবন পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। অথচ তার অটোবায়োগ্রাফিতে সেই দম্ভ নেই। অতি সরলতায় লেখা সত্যকথন। যেন ইতিহাস উঠে এসেছে কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। এখানেই মুজিব অনন্য। এখানেই মুজিব অসাধারণ। তার অটোবায়োগ্রাফির বাইরে গিয়ে আরেকজনের একটি লেখার অংশ বিশেষ এখানে শেয়ার করবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। লেখাটি বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন চিফ সিকিউরিটি অফিসার মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের। তার জবানিতেই তুলে ধরা হল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার এক স্মৃতিময় কথকতা।

‘‘একদিন গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর মাঝ পথে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামিয়ে বললেন, বাবুবাজার যাও। চাউলের দাম কতো তা যাচাই করতে হবে। এদিকে তাকে পাহারারত গাড়ি অনেক দূরে চলে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কথায় গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দৌড়ে গিয়ে ব্যবস্থা নিতে হলো। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে একাই বসে ছিলেন একেবারে নিরাপত্তাহীন।

আবার কখনো বলতেন, মিরপুর বস্তিতে যাব। বস্তির মানুষ কীভাবে আছে তা দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে দেশের রাষ্ট্রপতি বা দেশের প্রধান তার নির্দেশতো অমান্য করার কোন অবস্থা আমার বা অন্য কারো ছিলো না।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের কারণে প্রায়ই সময়ই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। তিনি বলেন, একদিন আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম স্যার, আমাকে দুইটি ওয়ারলেস সেট কিনে দিন। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওয়ারলেস সেট দিয়ে তুই কী করবি। তখন বলেছিলাম, স্যার কোথাও যাওয়ার সময় মাঝপথে মত পাল্টাচ্ছেন তখন আপনাকে অনিরাপদ রেখে ছুটতে হয়। ওয়ারলেস সেট থাকলে আপনাকে একা ফেলে দৌড়ে যেতে হবে না। বঙ্গবন্ধু তখনও আমার কথায় সাড়া দেননি।

সে সময় ই এ চৌধুরী নামের একজন এসপি ছিলেন। তাকেও ওয়ারলেস কেনার বিষয়ে জানিয়েছিলাম। একদিন এসপি ই এ চৌধুরী আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ারলেস সেট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বললেন। তখন এর দাম কতো জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, ২২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আরও বেশি দামের রয়েছে। এ সময় ওয়ারলেস সেটের দাম শুনে ধমক দিলেন এবং বললেন আমার দেশের মানুষ না খেয়ে মরে যাচ্ছে, যুদ্ধবিধস্ত দেশ, পাকিস্তান দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলে রেখে গেছে আর তুই আমার নিরাপত্তার জন্য ওয়ারলেস কিনতে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করবি।

তখন উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেন, জন এফ কেনেডিকে মেরে ফেলেছে। তার নিরাপত্তার জন্য কতো ব্যবস্থা ছিল। কই এতো নিরাপত্তায়ও তো কেনেডিকে বাঁচানো যায়নি। আল্লাহ যখন মৃত্যু লিখে রেখেছে তখনই আমার মৃত্যু হবে। এভাবেই ওয়ারলেসে সেট কেনার বিষয়টি বাতিল করে দেন বঙ্গবন্ধু।’’

এই মার্চ বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক একটি মাস। এ মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এই মাসেই তিনি জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইতিহাস গড়া এক ভাষণ দেন। এ মাসেই তিনি নিজেদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকালই অসম্ভব সৎ এবং নিষ্ঠাবান ছিলেন। ক্যারিশমাটিক এই নেতা তার আবেগময় জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে সহজেই জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারতেন, এ কথা আমরা জানি। কিন্তু তার সরলতা, সহজ জীবন যাপন, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, বিশ্বাসের গভীরতা আমরা সেভাবে জানি না। তার সরলতা এবং দেশের মানুষের প্রতি অন্ধ ভালবাসার কারণেই তিনি কে শত্রু আর কে মিত্র সেটি ধরতে পারেননি, সরল বিশ্বাসে পুরো জাতিকেই তার সন্তান বলে মনে করেছেন এবং সন্তান যে একদিন পিতাকে হত্যা করবে– এমন ভাবনা বা আশংকা তার মধ্যে কোনোদিনও আসেনি। এ কারণেই মুজিব হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পেরে তাজউদ্দিন স্বগতোক্তি করে বলেছিলেন,

‘বঙ্গবন্ধু জানতে-ও পারলেন না কে তার শত্রু আর কে তার বন্ধু ছিল!’

মুজিবকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা তখন আলোআবছায় ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই সময় মুজিব সেই আশঙ্কাতুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। তার বিশ্বাস মতে, এমন কিছু কেউ করতেই পারে না। এই সরলতাই তার কাল হয়। তবে ওই বিশ্বাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে কতটা সোজা সরল মানুষ ছিলেন, সেটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধু তার ক্ষমতায় থাকাকালে মিন্টো রোডে প্রেসিডেন্ট হাউজে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস করতেন, তারপর চলে আসতেন শেরেবাংলা নগরের সচিবালয়ে যেখানে তিনি রাত ৯/১০টা পর্যন্ত অফিস করতেন। ওখানেই তিনি দুপুরে কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন, সময় সুযোগ পেলে বিকেলে লেকে মাছদের খাবার দিতেন, লনে একটু হাঁটাহাটি করতেন। বঙ্গভবন বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসভবন হলেও তিনি রাতে ওখানে থাকতেন না, থাকতেন ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের নিজ বাড়িতে। একজন রাষ্ট্রনায়ক সরকারি সুযোগসুবিধা নিচ্ছেন না এবং নিজের নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি ফোর্স রাখছেন না– এখান থেকেই সুস্পষ্ট হয়, বঙ্গবন্ধু কোনোদিনও দুর্নীতিবাজ ছিলেন না। একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক মুজিব সম্পর্কে যেমনটা লিখেছেন,

“অন্যান্য মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির মত মুজিবও তার বাড়ি ভালবাসতেন। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখনও তাঁর বসবাসের ধরন পরিবর্তিত হয়নি। তাঁর বাড়িতে কোন গালিচা বা নতুন আসবাবপত্র ছিলোনা। তিনি মাছ, মুড়ি, দই ও গুড় পছন্দ করতেন। তিনি লুঙ্গী ও গেঞ্জি পরে বাসায় বিশ্রাম নিতেন। তিনি ক্ষমতার শীর্ষে গিয়েও একজন মধ্যবিত্ত বাঙালিই থেকে যান!”

ইতিহাস আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়, কিন্তু তা আমরা গ্রহণ করতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষাও যদি আমাদের নেতারা নিতে পারতেন, তাহলে এই দেশ ‘সোনার বাংলা’ হতে পঞ্চাশ বছর লাগত না।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

Link copied!