পরিবারের আদরের খোকা যেভাবে বাঙালির বঙ্গবন্ধু

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ১৭, ২০২৩, ০১:৩২ এএম

পরিবারের আদরের খোকা যেভাবে বাঙালির বঙ্গবন্ধু

বাঙালির কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম বঙ্গবন্ধু। যিনি হয়ে ওঠেন প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি ও হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাখো ছাত্র-জনতা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অন্যতম এই মহান নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করে।

কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো যাকে দেখে হিমালয় না দেখার আক্ষেপ ঘুচিয়েছিলেন তিনিই বঙ্গবন্ধু। বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ৬ দফা’র এই প্রণেতা জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুনের ঘর আলোকিত করে ধরণীতে আসেন বাংলার এই সূর্যসন্তান। বাবা-মা আদর করে নাম রাখেন ‘খোকা’। পরবর্তীতে এই খোকাই হয়েছেন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

শৈশব থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর-অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের তীব্র প্রতিবাদী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন পরোপকারী। তাইতো গ্রামের পথেপ্রান্তরে প্রখর রোদে কোনো এক বৃদ্ধাকে ভিক্ষা করার সময় তার গা থেকে ঘাম ঝরার দৃশ্য দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। নিজের মাথার ওপরকার ছাতাটি ওই বৃদ্ধাকে দিয়ে দিয়েছেন হাসিমুখেই।

নিজের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে বঙ্গবন্ধু  বলেছেন, ‘মাস্টার সাহেব একটা মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং সেই চাউল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু নিজেকে প্রথমে এলাকাবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। পরে এই সেবার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে একদিন সেই কিশোর মুজিবই গোটা দেশের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

ছয় ভাইবোনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তাঁর সাত বছর বয়সে। নয় বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে এবং পরে ম্যাট্রিক পাশ করেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে। তেরো বছর বয়সেই তিনি গোপালগঞ্জে স্বদেশী আন্দোলনের এক জনসভায় জনতার ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ দেখে বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে ওঠেন। তখন বিক্ষোভকারীদের সাথে তিনিও যোগ দেন।

তিনি জনগণের সেবাকে রাজনীতি বলতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন, ‘জনতার বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসক যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়’। 

গোপালগঞ্জ হাইস্কুলে পড়ার সময় মুসলিম ছাত্রদের সাহায্যের জন্য তিনি একটা দল গড়ে তুলেছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি ভিক্ষা করতেন। নানাভাবে সাহায্য নিয়ে গরিব ছাত্রদের বই-খাতা কিনে দিতেন। থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন, অর্থ সাহায্য করতেন। ছোটবেলা থেকেই মানুষকে সংগঠিত করা গুণটি তার ছিল।

চৌদ্দ বছর বয়সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন হঠাৎ মুজিব আক্রান্ত হয়ে পড়েন বেরিবেরি রোগে। এই বেরিবেরি রোগ থেকেই তার চোখে ‘গ্লুকুমা’ নামের জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। চোখের অপারেশনের মাধ্যমে সুস্থ হলেও ডাক্তার তাকে নিয়মিত চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। চক্ষু সমস্যার কারণে দু বছর তাঁর পড়াশোনাও বন্ধ ছিল। সেই যে তাঁর চোখে উঠল মোটা ফ্রেমের চশমা, সেটি আর নামেনি। সেই চশমার মোটা কাঁচ ভেদ করে যে আলোক রশ্মি মুজিবের পৃথিবী একদিন আলোকিত করেছিল, সেই আলোতেই এই বাঙালি জাতি পেয়েছিল মুক্তির দিশা।  

শারিরীক এসব বাধা তাঁকে দমাতে পারেনি কোনোদিন। পড়াশোনা ও রাজনীতি— কোনোটি থেকেই তিনি মনোযোগ সরাননি। বঙ্গবন্ধু যখন মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশনারি হাই স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন।

শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল- বাংলার স্বাধীনতা, বাঙালির অধিকার ও জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এই আদর্শ চেতনায়ই বঙ্গবন্ধু বড় হয়ে ওঠেন।

১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে অবস্থান করে পড়াশোনা করতেন। এখান থেকেই ১৯৪৪ সালে শেখ মুজিব আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে মোগলটুলির কর্মীক্যাম্পে অবস্থান করেন। ১৯৪৭ সালের শেষদিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই অভিযোগে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুনরায় পড়াশোনার সুযোগ দিতে রাজি এই শর্তে যে, ভবিষতে ভালো হয়ে চলার ‘বন্ড’ স্বাক্ষর করা এবং পনেরো টাকা জরিমানা প্রদানের বিনিময়ে। কিন্তু তিঁনি কোনোটিই করতে রাজি হননি; বহিস্কৃত হওয়ার পর তিঁনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫২ সালের শেষ সময় পর্যন্ত বন্দিজীবন অতিবাহিত করেন।

রাজনীতির কবি যার আদর্শকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনী সম্পর্কে অসংখ্য বই রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বইগুলো হল অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিব আমার পিতা প্রমুখ।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।’ এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, শেখ মুজিব শুধু বাঙালিকে নিয়ে ভাবেননি, তিনি ভেবেছেন বিশ্বে তাবৎ নিপীড়িত মানুষেরেই কথা। মূলত তিনি ছিলেন বিশ্বনেতাদেরই একজন। বাঙালির বিশ্বমুখ।

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!