সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ০৬:০১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে নারীদের কথা আমলে নিতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংরক্ষিত নারী আসন ও ৩০০ আসনে মনোনয়ন নিয়ে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রস্তাবিত জুলাই সনদে তা তুলে ধরতে হবে। নারীদের কথা না শুনলে নারীরা ভোটের সময় নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে।
রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ‘নারীর রাজনৈতিক ফোরাম’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন বক্তারা।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর–রুনি মিলনায়তনে ‘জাতীয় নির্বাচনে নারীর অধিকার আদায়ের রূপরেখা’ বিষয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করে তাতে সরাসরি নির্বাচন এবং ৩০০ আসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর জন্য ৩৩ শতাংশ মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানানো হয়। দাবি আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন বক্তারা।
প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই পর্বে আলোচনা শেষ হয় ৩১ জুলাই। কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, আগের মতো জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০ থাকবে এবং দলীয়ভাবে মনোনয়ন ব্যবস্থা থাকবে। আর ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলগুলো ৫ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দেবে নারীদের। ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থীর মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দলগুলো পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক নির্বাচনে ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত রাখবে। প্রস্তাবিত জুলাই সনদের ২৪ অনুচ্ছেদে এসব প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরুর দাবি জানিয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৩১ আগস্ট আত্মপ্রকাশ করে ‘নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’ নামের প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মে রয়েছে ১২টি সংগঠন।
আজ সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকারকর্মী ফারাহ্ কবির বলেন, ‘অনেকে মনে করছেন, আমরা শুধু ঢাকায় বসে বসে নারীর কথা আলোচনা করছি। বিষয়টি তা নয়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সারা দেশের প্রান্তিক নারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে আনা হয়েছে। তারা ঢাকায় এসে নিজেরা কথা বলার সুযোগ পান না। আমাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা তাদের হয়ে কথা বলছি।’ তিনি বলেন, নারীরা ভোটার হিসেবে ও নেতৃত্ব দিতে ভোটে অংশ নিতে চান। জবাবদিহির মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে যে যোগ্যতা প্রয়োজন, সেটা নারীদের আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছি। একাধিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি। আরও দলের সঙ্গে কথা বলা হবে। আমরা আশা রাখি, তারা নারীদের উদ্বেগ বুঝতে পারবে।’ তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ ও প্রান্তিক নারীদের সঙ্গে কথা বলে নারীরা কী চান, সেই আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে আনা হয়েছে ফোরামের আলোচনায়। নারীরা সংরক্ষিত আসন ১০০ চাইছেন, তাতে সরাসরি নির্বাচন চাইছেন। এই তথ্যগুলো রাজনৈতিক দল যেন আমলে নেয়। কোন দল প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, তা বুঝতে পারলে নারীরা নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এখন ভুলের পথ থেকে ফেরত আসার সময় রয়েছে। দলগুলোকে পুরোনা রাজনৈতিক হিসাবের বাইরে আসতে হবে। নারীদের কথা আমলে না নিলে বিপদ দলগুলোরই হবে।
প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনেই সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করা সম্ভব। নারী নেতৃত্ব প্রস্তত আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলে ১০০ আসনে কীভাবে সরাসরি নির্বাচন করা যায়, সেই পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের আলোচনায় নারী আসন নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নারীর প্রত্যাশার বাইরে। এটা হতাশাজনক। ৫১ শতাংশ নারীর প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে জুলাই সনদ হলে, নারীর কণ্ঠ বাদ দিয়ে জুলাই সনদ হলে, সেই সনদ নারীদের কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।
শ্রমিকনেতা তাসলিমা আখতার বলেন, দুটি বিষয়কে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। এক. সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ১০০ করে তাতে সরাসরি নির্বাচন। দুই. ৩০০ আসনে নারীকে অন্তত ৩৩ শতাংশ মনোনয়ন। প্রস্তাবিত জুলাই সনদে সংসদের সংরক্ষিত আসনকে ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হবে কি না, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন ও এর পদ্ধতি নিয়ে তারা আলোচনা করতে আগ্রহী বলে জানান।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, তাসলিমা আখতার, নারীপক্ষ’র সদস্য সাদাফ সায্ সিদ্দিকী ও নারী মুক্তি কেন্দ্রের সুস্মিতা রায়।
লিখিত বক্তব্য বলা হয়, নারীর প্রতিনিধিত্বকে প্রতীকী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। সংসদে নারীর ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব এখনই বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ধাপে ধাপে সেটিকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। শুধু দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে না।
৯ সেপ্টেম্বর নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের প্রতিনিধিদল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে। কমিশন জানিয়েছে, নীতিগতভাবে কমিশন ফোরামের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। তারা এই প্রস্তাব ও দুই সংস্কার কমিশনের রূপরেখা নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও দর–কষাকষি করেছেন। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে জিতে আসার মতো যথেষ্ট পরিমাণ যোগ্য নারী না পাওয়ার কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলো ২০২৬-এর নির্বাচনের জন্য নারী মনোনয়নের হার কোনোভাবেই ৫ শতাংশের বেশি বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয়নি। ২০২৫ সালে নারীরা যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষায়, যোগ্যতায়, কর্মস্থলে, আন্দোলনে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, রাজনৈতিক দলের ভেতরে তাদের এভাবে প্রান্তিক অবস্থানে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা তাই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে একটি চিঠি দিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একটি বৈঠক করার জোর দাবি জানানো হয়। কিন্তু কমিশন জানিয়েছে তারা এ ধরনের সভার আয়োজন করতে পারবে না। আরও হতাশার বিষয় হলো, জুলাই সনদের নারী প্রতিনিধিত্ব–বিষয়ক অধ্যায়ে ফোরামের প্রস্তাবও কার্যত আমলে নেওয়া হয়নি।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে রাজনৈতিক দল মনোনীত কিংবা স্বতন্ত্র—সব নারী প্রার্থীর জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিশেষ আর্থিক সহায়তা বরাদ্দ দিতে হবে। নির্বাচনী ব্যয়সীমার অঙ্কের সমপরিমাণ অর্থ মঞ্জুরি হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বরাদ্দ দেওয়ার বিধান করতে হবে। এর ফলে আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক যোগ্য নারী প্রার্থী নির্বাচন থেকে পিছিয়ে যাবেন না।