দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনা-অপেক্ষা শেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। নির্বাচন অবশ্যই উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
রবিবার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলবে ভোট গ্রহণ। এরইমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হচ্ছে। শুধু দুর্গম অঞ্চলের দু’হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হয়েছে ভোটের আগের দিন (৬ জানুয়ারি)।
৩০০ আসনের মধ্যে একটি আসন বাদে ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ চলবে। নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলামের মৃত্যুতে আসনটিতে নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। আর ৩০ দেশের ১১৭ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন পেয়েছেন।
নির্বাচনে অংশ নিয়েছে যেসব রাজনৈতিক দল
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ১,৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১,৫৩৪ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি-জেপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ কংগ্রেস, তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপি।
নির্বাচনি ময়দানে থাকছে না বিএনপি-জামায়াত জোট। তবে কিছু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।বিশেষ করে নৌকা ও স্বতন্ত্রদের লড়াই চলবে।
ভোটার ও ভোটকেন্দ্র
ইসির তথ্য অনুসারে, ১১,৯৩,৩২,৯৩৪ জন ভোটার রয়েছে, যার মধ্যে ৬,০৫,৯২,১৯৭ জন পুরুষ, ৫,৮৭,৩৯,৮৮৯ জন মহিলা এবং ৮৪৮ জন হিজড়া। নির্বাচনী এলাকার ৪২,০২৪ টি ভোটকেন্দ্রের ২,৬০, ৮৫৬টি বুথের অধীনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে প্রায় ১০,০০০ ভোট কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে ভোট কেন্দ্র, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ভবনের নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছে ইসি।
এবার ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
৫৯০ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসারের মধ্যে ৪৯৩ টি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগণ (ইউএনও), ৫৬ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকারের ১৪ জন উপ-পরিচালক, ৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১১ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, পাঁচজন সেনানিবাসের নির্বাহী কর্মকর্তা, দুইজন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং একজন সার্কেল কর্মকর্তা- নির্বাচন পরিচালনা করবেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের সুরক্ষার জন্য ১৫-১৭ জন নিরাপত্তা সদস্যের একটি থাকবে কারণ নির্বাচন কমিশন মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অবস্থিত ভোট কেন্দ্র এবং মেট্রোপলিটন এলাকার অভ্যন্তরে অবস্থিত কেন্দ্রগুলির জন্য পৃথক নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে দুইজন পুলিশ, অস্ত্রসহ একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠি হাতে একজন আনসার, লাঠি হাতে ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দুইজন গ্রাম পুলিশ সদস্যসহ ১৫-১৬ জনের একটি দল প্রতিটি সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে (যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত) অস্ত্রসহ তিনজন পুলিশসহ ১৬-১৭ জনের একটি দল থাকবে। মেট্রোপলিটন এলাকার অভ্যন্তরে, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ১৫ সদস্যের একটি নিরাপত্তা দল যার মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্য অস্ত্রসহ, একজন আনসার অস্ত্রসহ, আরেকজন আনসার অস্ত্র বা লাঠিসহ এবং ১০ জন আনসার সদস্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।
এছাড়াও সারাদেশে নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখতে প্রায় আট লাখ নিরাপত্তাকর্মী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে ৩৮,১৫৪ জন সেনা সদস্য, ২,৮২৭ জন নৌবাহিনী (১৯ জেলা), ৪৪,৯১২ (১১৫১ প্লাটুন) বিজিবি সদস্য, ২,৩৫৫ (৭০ প্লাটুন) কোস্টগার্ড সদস্য, ৬০০ র্যাব টিম এবং ৯৫ টি র্যাব রিজার্ভ দল, ১,৭৪,৭৬৭ জন পুলিশ সদস্য এবং ৫,১৪,২৮৮ জন আনসার সদস্য।
যান চলাচলে নির্দেশনা
নির্বাচন উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে ইসির স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে ভোটগ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিবসের পূর্ববর্তী মধ্যরাত অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত কতিপয় যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ক্যাব, পিক আপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক।
এসব নিষেধাজ্ঞা নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য হবে : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক; জরুরি সেবা কাজে নিয়োজিত যানবাহন এবং ওষুধ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও অনুরূপ কাজে ব্যবহৃত দ্রব্য ও সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন; আত্মীয়-স্বজনের জন্য বিমানবন্দরে যাওয়া, বিমানবন্দর হতে যাত্রী বা আত্মীয়-স্বজনসহ নিজ বাসস্থানে অথবা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত যানবাহন (টিকেট বা অনুরূপ প্রমাণ প্রদর্শন) এবং দূরপাল্লার যাত্রী বহনকারী অথবা দূরপাল্লার যাত্রী হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে যাতায়াতের জন্য যেকোনো যানবাহন; প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য ১টি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনি এজেন্টের (যথাযথ নিয়োগপত্র/পরিচয়পত্র থাকা সাপেক্ষে) জন্য ১টি গাড়ি (জিপ, কার, মাইক্রোবাস ইত্যাদি ছোট আকৃতির যানবাহন) রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন ও গাড়িতে স্টিকার প্রদর্শন সাপেক্ষে চলাচলের অনুমতি প্রদান; সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক অথবা জরুরি কোনো কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল রিটার্নিং অফিসারের অনুমোদন সাপেক্ষে চলাচলের অনুমতি প্রদান; নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির জন্য মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি প্রদান; জাতীয় মহাসড়ক, বন্দর ছাড়াও আন্তঃজেলা বা মহানগর থেকে বাহির বা প্রবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মহাসড়ক ও প্রধান প্রধান রাস্তার সংযোগ সড়ক বা এমন সব রাস্তায় নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন এবং স্থানীয় প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতার নিরিখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা কর্তৃক কতিপয় যানবাহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা শিথিল করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন।