ইসকন কী? কীভাবে এলো বাংলাদেশে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৭:৩৭ পিএম

ইসকন কী? কীভাবে এলো বাংলাদেশে?

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ইসকনের বহিস্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় সারাদেশে এক ধরণের উত্তেজনা বিরাজ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে চিন্ময়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ চলছে দেশ ও দেশের বাইরে।

চিন্ময় গ্রেপ্তারের পরই ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে ইসকন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বব্যাপী এই সংগঠন নিষিদ্ধের দাবিতে বাংলাদেশে মাঠে নেমেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সভা সমাবেশ ছাড়াও ইসকন নিষিদ্ধের বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে।

২৮ নভেম্বর সকালের মধ্যে ইসকন ইস্যুতে সরকারের অবস্থান ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানাতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এনিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না হয় সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলেছেন আদালত। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যার্টনি জেনারেলকে ডেকে পাঠান আদালত।

ফলে জনমনে নানা ধরণের জল্পনা-কল্পনা ও প্রশ্ন উঠেছে ইসকন ও এই সংগঠনের কাজ ও তৎপরতা নিয়ে। আসুন দেখে নেয়া যাক- ইসকন কী? কীভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত হলো? আর কীভাবেই-বা বাংলাদেশে এলো এই সংগঠনটি? 

ইসকন কী?

ইসকন হল একটি ধর্মীয় আন্তর্জাতিক সংস্থা। ইসকনের পূর্ণরূপ হলো- আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ, ইংরেজিতে International Society For Krishna Conciousness।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদের অনুসরণে এই সংগঠনটি জন্ম নেয়। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীল অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ, যিনি শ্রীল প্রভুপাদ নামেই পরিচিত। ইসকনের সদর দপ্তর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়ার মায়াপুরে।

সংগঠনটির বিভিন্ন লিটারেচার থেকে জানা যায় যে, ইসকন প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টা করে। তাদের ভিত্তি হল ভাগবত গীতার শিক্ষা ও চৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তি আন্দোলন। 

চৈতন্য মহাপ্রভুর মতবাদ অনুসারে, এই অনুশীলনের জন্য একজনকে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করার প্রয়োজন নেই, জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ অনুশীলন করতে পারে।

কে এই শ্রীল প্রভুপাদ?

ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরনারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের প্রকৃত নাম অভয়চরণ দে। ভক্তরা তাকে চিন্ময় জগতের দূত, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সেনাপতি এবং ভক্তিবেদান্ত প্রভৃতি নামে অভিহিত করে। তিনি হরে কৃষ্ণ আন্দোলনেরও প্রবর্তন করেন।

শ্রীল প্রভুপাদের জন্ম ১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমীর দিনে ভারতের কলকাতায় সুবর্ণবণিক পরিবারে। তার পিতা গৌর মোহন দে এবং মাতা শ্রীমতি রজনী দে উভয় ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত। তিনি নিজেও ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর শিষ্য ছিলেন। হিন্দুধর্মের গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদটি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তার জীবনের উদ্দেশ্য।

কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের অভয়চরণ দে ব্যক্তিজীবনে বিবাহিত ছিলেন এবং তার সন্তানাদিও ছিল। তিনি ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষা নিয়েও অধ্যয়ন করেন। 

৬৩ বছর বয়সে, ১৯৫৯ সালে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৬০-এর দশকে গৌর বাণী প্রচারের জন্য তিনি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে আমেরিকায় যান।

১৯৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্মাষ্টমীর পরের দিন তিনি পাশ্চাত্যে প্রথম দীক্ষা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন এবং ১১ জনকে দীক্ষা দেন। প্রতিষ্ঠা করেন ইসকন, হয়ে ওঠেন পাশ্চাত্য বিকল্প সংস্কৃতির এক অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার এই জগৎজোড়া খ্যাতির কারণে বিশ্বখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার তাকে ‘ক্যারিশম্যাটিক নেতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

তিনিই প্রথম ব্যাক্তি যিনি পশ্চিমা কোন দেশে ১৯৬৭ সালের ৯ জুলাই সানফ্রান্সিসকো শহরের রাজপথে রথযাত্রা পরিচালনা করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

ইসকনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও বিস্তার

ইসকনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে জনসেবা, শিক্ষা, ধর্মচর্চা, অধ্যাত্মিক চর্চা’ করা। তাদের লিটারেচার থেকে জানা যায়, এই সংঘের উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনা। 

ইসকনের মূল শিক্ষা হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বশক্তিমান পরম ঈশ্বর এবং তার উপাসনা ও প্রেমের ভক্তিই জীবনের মূল লক্ষ্য। এটি বৈষ্ণব ধর্মের গৌড়ীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত এবং চারটি মূল বিষয়ের উপর জোর দেয়: ১. কৃষ্ণভক্তি চর্চা; ২. জপ ও কীর্তনের মাধ্যমে নাম সংকীর্তন; ৩. ভক্তি আন্দোলনের প্রসার; ৪. বৈষ্ণব আচার-অনুষ্ঠানের পালন।

ইসকনে দীক্ষা নেয়ার সময় ভক্তরা চারটি মৌলিক বিধি ও নিয়ম অনুসরণ করেন। সেগুলো হলো- ১) ল্যাক্টো নিরামিষ জাতীয় খাদ্য কৃষ্ণ প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ; ২) নেশা জাতীয় দ্রব্য, যেমন- অ্যালকোহল, সিগারেট বা অন্য কোনো মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা; ৩) জুয়া না খেলা; এবং ৪) অবৈধ যৌনতা পরিহার করা।

ইসকন প্রচারের পক্ষে সদস্যরা প্রাথমিকভাবে প্রকাশ্য স্থানে হরে কৃষ্ণ মন্ত্র গেয়ে এবং বিভিন্ন ভাষায় বৈদিক বই বিক্রি করে কৃষ্ণচেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। 

দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক পূজা পার্বণের পাশাপাশি ইসকন ভক্তরা জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, দিপাবলি, গৌর পূর্ণিমা, একাদশী, হোলি, রাম নবমী এবং গীতা জয়ন্তীসহ বিভিন্ন ধরনের হিন্দু উৎসব উদযাপন করেন।

ইসকন সংঘটি পরিচালনার জন্য একটি গভর্নিং বডি কমিশন বা জিবিসি রয়েছে। এই কমিশনের কাজ হল- মন্দির পরিচালনার মান উন্নত করা, কৃষ্ণ চেতনার বিস্তার, বই ও সাহিত্য বিতরণ, নতুন কেন্দ্র খোলা এবং ভক্তদের শিক্ষা প্রদান করা। কমিশনের সদস্য সখ্যা ৪৮, যারা ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলে সংগঠটি দাবি করে। 

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্বজুড়ে ভক্তদের জন্য ১০০টিরও বেশি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ইসকন ১০০টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ইসকনের ৫০০০০ টিরও বেশি মন্দির এবং কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি খামার সংগঠন, ৫৪টি বিদ্যালয় ও ৯০টি ভোজনালয়। বর্তমানে পূর্ব ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্য এশিয়ায় ও ভারত উপমহাদেশে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

কীভাবে বাংলাদেশে এলো?

বাংলাদেশে ইসকনের সংগঠিত কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। তবে ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আগেও পাকিস্তান আমলে কিছু লোক ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণভক্তির চর্চা করতেন।

ঢাকা থেকেই এর সূচনা হয়। প্রথমদিকে কিছু ভক্ত এবং বিদেশি প্রতিনিধির সহযোগিতায় এর কার্যক্রম খুব সীমিত পরিসরে শুরু হয়। পরে ১৯৮০-এর দশকে এটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

ইসকনের প্রথম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকায়। এরপরে চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ অন্যান্য বড় শহরে ইসকনের শাখা গড়ে ওঠে। 

বাংলাদেশে ইসকনের প্রসার ঘটে ভক্তি আন্দোলনের প্রচার এবং সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে।

ইসকন এখানে বিশেষত তিনটি উপায়ে কাজ করে: ১) ধর্মীয় অনুষ্ঠান: জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা এবং গৌর পূর্ণিমার মতো উৎসব বড় আকারে উদযাপন করা হয়; ২) শিক্ষা ও প্রচার: ভাগবত গীতা এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের প্রচার করা হয়; ৩) সামাজিক কার্যক্রম: বিনামূল্যে প্রসাদ বিতরণ এবং দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সহায়তা।  

বাংলাদেশে ইসকনের ১০০টিরও বেশি মন্দির এবং আশ্রম রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:  ঢাকার স্বামীবাগ আশ্রম; চট্টগ্রামের চক্রেশ্বর মন্দির; ময়মনসিংহের নিত্যানন্দ ধাম। এছাড়া ইসকন শিক্ষামূলক কার্যক্রমেও সম্পৃক্ত। তারা ভাগবত গীতা এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ ও প্রচার করছে। ‘ফুড ফর লাইফ’ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের জন্য খাবার বিতরণ করছে।

ইসকন নিয়ে সমালোচনা

ইসকন প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সংঘের মধ্যে কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখা যায়, বিশেষভাবে প্রভুপাদের মৃত্যুপরবর্তী যুগে তা বেড়ে যায়। ১৯৯০-এর দশকে ইসকনের কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, উগ্রবাদীতার কারণে সিঙ্গাপুরে ইসকন এখনো নিষিদ্ধ। চীন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আফগানিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ায়ও ইসকন নিষিদ্ধ। এছাড়া তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানে ইসকনের কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি জারি রয়েছে।

Link copied!