বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা মিটিং কেন বয়কট করল ছাত্রদল, ছাত্রফেডারেশন ও ছাত্রফ্রন্ট?

বিশেষ প্রতিবেদক

ডিসেম্বর ৫, ২০২৪, ০৪:২০ এএম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা মিটিং কেন বয়কট করল ছাত্রদল, ছাত্রফেডারেশন ও ছাত্রফ্রন্ট?

৫ আগস্ট শেষ হাসিনা সরকার পতনের পর ড. ইউনূস বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে তাকে এয়ারপোের্টে স্বাগত জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে রাতারাতি সারাদেশে সকলের কাছে পরচিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‍‍`বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন‍‍`।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে সচিবালয় সর্বত্র যখনই যেই ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তখনই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে দেশের অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো।

এবারই প্রথম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক, জুলাই বিপ্লবের অন্যতম শীর্ষ নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ’র ডাকে তাদের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে দেখা যায় নি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলসহ বেশ কিছু বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে।

ঘটনা গত বুধবার রাতের। এর আগের দিন মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন হাসনাত আব্দুল্লাহসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ কয়েকজন নেতা।

যদিও বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, এএফপির সাবেক সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সকলের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিবেন প্রধান উপদেষ্টা। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই ধারাবাহিকতা শুরু হবে। এরপর প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এবং ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গেও বৈঠকে বসবেন।

এরপর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে যমুনার গেটে দেখা যায়, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে।

মঙ্গলবার রাতে যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন হাসনাত আব্দুল্লাহসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন শীর্ষ নেতা। ছবি: দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভ

 

জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অপর তিন শীর্ষ নেতা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।

এদের মধ্যে নাহিদ ইসলাম তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, আসিফ মাহমুদ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং জুলাই বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত মাহফুজ আলম প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং বর্তমানে দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করছে।

ওইসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক শীর্ষ নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ৫ আগস্টের আগে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এখনও অটুট আছে বলে আমরা মনে করি।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছাত্রনেতাদের বৈঠকের নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের এই বৈঠককে ভালভাবে নেয় নি ছাত্রদল, ছাত্রফেডারেশন, ছাত্রফ্রন্টসহ মূলধারার ছাত্রসংগঠগুলোত, যারা এতোদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্মে সকল আন্দোলনে এক কাতারেই ছিল।

এমনকি পরদিন বুধবার রূপায়ন টাওয়ারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবগঠিত কার্যালয়ের ডাকা বৈঠকেও যোগ দেয় নি তারা। যদিও একই কার্যালয়ে ডাকা গত সপ্তার এক বৈঠকে হাসনাত আব্দুল্লার নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিলেন ওই ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা।

গত সপ্তায় সব ছাত্রসংগঠন মিলে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ ব্যানারে ‍‍`জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ‍‍` পালনের ঘোষণা রূপায়ন টাওয়ারে। 

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুধবার রাতে রূপায়ন টাওয়ারে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালন শেষে ধারাবাহিক আলোচনার অংশ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মতবিনিময় ডাকে।  এতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের ছাত্র সংগঠন অংশ নিয়েছিল। অংশ নেয় নি, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলোর বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন।

মতবিনিময়ে অংশ না নেওয়া ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা নেতারা রক্ষা করতে পারেননি। সেজন্য তারা এই সভা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

মতবিনিময়ে উপস্থিত না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অর্ন্তবর্তী সরকার সংস্কার প্রকল্প, শহীদদের নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগসহ নানাবিধ কার্যক্রমে ছাত্রদের যুক্ত করার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা সবক্ষেত্রে দেখেছি কেবল একটি সুনির্দিষ্ট পক্ষকেই সব কার্যক্রমে যুক্ত করা হচ্ছে। অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনাও করা হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনার নামে কেবল কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এতে জুলাই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় ঐক্যেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা এখন একটি পক্ষের সংকীর্ণ গ-িতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।’

বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ছাত্রদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বলে জানান তিনি।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ গত ১২ আগস্টের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে অঙ্গীকার করেছিলো, সকল ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বসা হবে এবং সবার মতামত নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আমরা দেখছি, তারা সে অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে। বর্তমানে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সব সংগঠনকে বাদ দিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে সকল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে। এর দায় তারা কোনমতেই অস্বীকার করতে পারে না।

ছাত্র ফেডারেশনের (গণসংহতি) সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমরা সকল ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে জাতীয় ছাত্র কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়েছিলাম উপস্থিত ছাত্র সংগঠনের বেশিরভাগই সেই দাবিতে একমত ছিলেন। যার মাধ্যমে ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যেতো। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে নিজেদেও গোষ্ঠীগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তারা ছাত্র সংগঠনগুলো দূওে ঠেলে দিয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করেছি, সকলের মাঝে ঐক্য টিকিয়ে রাখার মতো পরিপক্ক আচরণ তারা করেন নি। তাই আমরা আজকের বৈঠকে অংশ নেই নি।’

পরে রাত ১০টায় মত বিনিময় শেষে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ জানান, ‘আগামী জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে ডাকসুসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুরু হোক, এটা প্রত্যাশা করছি।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই জাতীয় নির্বাচনের আগেই ডাকসুসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক।’

এ সময় আবদুল হান্নান মাসুদ জানান, বুধবারের মতবিনিময়ের ৩০টি ছাত্র সংগঠন উপস্থিত ছিল।

 

Link copied!