যারা রাজধানীর ধানমণ্ডির ৫ নম্বর সড়কে হেঁটেছেন, তাদের চোখে “সুধা সদন” নামে একটি সুন্দর বাড়ি পড়েছেই, ওই বাড়িটির আড়ালে যে সুধা মিয়ার গল্প রয়েছে তিনিই আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ - ৯ মে ২০০৯)। দেশে আণবিক গবেষণার পথিকৃৎ এক নিভৃতচারী জ্ঞানতাপস। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ছিলেন তিনি। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও যিনি নিজেকে রেখেছিলেন ক্ষমতার বাইরে, একেবারে নির্মোহ এক চরিত্র হিসেবে তাকে দেখেছে এই রাষ্ট্র-সমাজ। তার জীবনাচার তাই তার কর্মের মতোই উজ্জ্বল। তিনি আমাদের দেশের বিশ্বমুখ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা— বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানার জীবনে নেমে এসেছিল গভীর দুঃখের ঘনঘটা, কেন না ওইদিনই সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে।
বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়ের ওই কঠিন দুঃসময়ে যিনি তার বুদ্ধিমত্তায় সুগভীর যত্নে, স্নেহে, ভালোবাসায় লালন পালন করেছেন, দেখে রেখেছেন, জীবনের নতুন মানে শিখিয়েছেন তিনিই হলেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা। তিনি আমাদের 'গরিব দেশের' আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী ছিলেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সুধা মিয়া। বাবা আব্দুল কাদের মিয়া এবং মাতা ময়েজুন্নেসা। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সুধা মিয়াকে মানসম্মত পড়াশোনার জন্য প্রাথমিকের পড়াশোনা শেষে রংপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেন বাবা। সেখান থেকেই তিনি ডিসটিনকশনসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন।
১৯৫৬ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, থেকেছেন ফজলুল হক হলে। এসময় থেকেই তার রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার শুরু এবং ১৯৬১ সালে ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এমনকি ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করে গ্রেপ্তার হন এবং কিছুদিন জেলও খাটেন। একজন বিজ্ঞানীর এই পুরোদস্তুর রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার ঘটনা ইতিহাসে কমই দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাশ করার পর পীরগঞ্জ গ্রামের ছেলে সেই সুধা মিয়া ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে আণবিক শক্তি কমিশনের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার বড় কন্যা শেখ হাসিনার জন্য এই সুধা মিয়াকেই পছন্দ করেন এবং এবছরই ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার নিজের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইটি থেকে জানা যায়, তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং তার স্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৫ আগস্টের সেই লোমহর্ষক ঘটনা জানিয়েছেন বা জানাতে বাধ্য হয়েছেন। কেন না তিনি ছাড়া সেসময় সদ্য বাবা মা ভাইসহ সকল নিকটাত্মীয় হারানো অসহায় এই দুইজন মেয়ের কাছের মানুষ আর কেউ ছিলো না। তিনিই এদেশ থেকে ওদেশ এই দুইবোনকে নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, আঁচড় লাগতে দেননি কখনো।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের ৯ মে কিডনিজনিত সমস্যা, হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন। তার গবেষণা কর্মের পরিধিও ছিল বিস্তৃত। বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়ের বিপদে সবচেয়ে কাছের মানুষ এম এ ওয়াজেদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার কর্মের মাধ্যমেই।