১৯৯৭ সালের ১৮ মে। রাত ২ টা বেজে ১৫ মিনিট। কলকাতা মহানগরীর একটি বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এক লোক। শহরের এক শ্মশানে চিতায় দাহ করার জন্য নিয়ে তাকে নিয়ে যান তার কন্যা শাওলী। দাহর জন্য শোয়ানো লোকটিকে চিনতে পেরে শ্মশানের এক কর্মচারী শাওলীকে জিজ্ঞেস করলেন, এই লোকটা কলকাতায় নাটক করে বেড়ান না?। শাওলীর কাছ থেকে শ্মশানের ওই কর্মচারী কোন জবাব পাননি। পাবার কথাও না। কেননা, মারা যাবার আগে, এই প্রচার বিমুখ মানুষটি তার কন্যার কাছে এক চিঠিতে লিখলেন, আমি সামান্য মানুষ, জীবনে অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি। তাই মরার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে পুড়ে যেতে পারে'।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয় এবং মান্না দে গেয়েছিলেন, কোথায় কবে কোন তারা ঝরে গেলো আকাশ কি মনে রাখে? সত্যিই তো! নক্ষত্রের পতনের রাতে আমাদের এই ধুলোমলিন পৃথিবী থেকে ঝরে গিয়েছিল আরো একটি নক্ষত্র। তার নাম শম্ভু মিত্র। বাংলা নাটকের জগতে এ ধ্রুবতারা। শম্ভু মিত্র সেই মানুষ যিনি নাটকের শেষ দৃশ্যের নিখুঁত দৃশ্যায়নের মতো তার জীবনের অন্তিম দৃশ্যের স্ক্রিপ্টও লিখেছিলেন।
১৯১৫ সালের ২২ আগস্ট কোলকাতার ডোভার রোডে শরৎকুমার ও শতদলবাসিনীর ঘরে এক শিশু জন্ম নিল। তার নাম রাখা হলো শম্ভু; শম্ভু মিত্র। তিনভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে ৭ম অবস্থান তার। পিতা শরৎকুমার ছিলেন জমিদারের উত্তরাধিকারী। তার পূর্বপুরুষ হুগলির কলাছড়া গ্রামের জমিদার হলেও জমিদারীতে শরৎকুমারের তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না। তিনি কাজ করতেন ভারতের জিওলজিক্যাল সার্ভের গ্রন্থাগার বিভাগে। সেখান থেকে অবসর নেয়ার পর সামান্য সঞ্চয় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশে।
শম্ভু মিত্রের মা শতদলবাসিনী বেচে ছিলেন খুব অল্প সময়। কিন্তু তার উপর তার মায়ের প্রভাব এতটাই বেশি যে, মায়ের কথা ভেবে কোনদিন সেভাবে অনৈতিক কাজের কথা ভাবতেও পারেননি। কেননা, তার বিশ্বাস ছিলো তার মা আকাশ থেকে সব দেখছেন।
শম্ভু মিত্রের পড়াশোনা ছিলো কোলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। এখানে পড়াকালীন তার আবৃত্তি ও অভিনয়ে আগ্রহ জন্মে। স্কুল জীবনেই মঞ্চের নাটকে তার আবির্ভাব হয় একদিন। নাটক ছাড়াও তার আগ্রহ ছিলো আবৃত্তিতে। প্রতিবেশি বড়দা প্রবোধ মিত্র তার জীবনে আবৃত্তির শেকড় গেড়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন বলে জানিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র নিজেই।
শম্ভু মিত্রের মেয়ে শাওলীর ভাষায়, কবিতা মুখস্থ করে ফেলার অভ্যাস ছিলো তার। কবিতা মুখস্ত করার ক্ষমতা ও নেশা দুটোই এত প্রবল ছিলো যে, তিনি রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা এবং চয়নিকা পুরোটাই মুখস্ত করে ফেলেছিলেন। এমনকি কোন কবিতা কোন পাতায় আছে তাও বলে দিতে পারতেন অবলীলায়।
১৯৩১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হলেও তার আর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ভালো লাগায় কলেজের পাট চুকিয়ে পরিবারের সাথে চলে যান উত্তর প্রদেশে। তারপর ১৯৩৬ এর শেষ কি ১৯৩৭ সালের শুরুর দিকে শম্ভু মিত্র ফের চলে আসেন কোলকাতায়। বিস্তর পড়াশোন আর নাটকের সাথে লেগে থেকে সম্ভবত ১৯৩৯ সালে তিনি যুক্ত হন রঙমহল থিয়েটারে।
রঙমহলে বেশ কয়েকটি পুরনো নাটকে অভিনয়ের পর মালা রায়, রতœদ্বীপ এবং ঘূর্ণি নামে তিনটি নতুন নাটকে অভিনয় করেন। রঙমহল থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেলে ভূমেন রায় শম্ভু মিত্র সেখান থেকে নিয়ে যান মিনার্ভা থিয়েটারে। সেখানে বেশ সমাদর পেলেও একদিন তার গুরুকে অপমানিত হতে দেখে রাগে দুঃকে মিনার্ভা ত্যাগ করেন। যান নাট্যনিকেতন থিয়েটারে। কিন্তু একদিন সেটাও বন্ধ হয়ে গেলে শিশির ভাদুড়ি সেটির মালিকানা নিয়ে তার নাম রাখেন, শ্রীরঙ্গম। শিশির ভাদুড়ির দলে এসে নতুন করে কাজ শুরু করেন শম্ভু মিত্র। এখানেই তার পরিচয় ঘটে শিশির ভাদুড়ির অভিনয় আর অভিনয় ধারার সঙ্গে। বেশ কয়েক বছর কাজ করে তিনি ১৯৪০-৪১ সালের দিকে তিনি শ্রীরঙ্গম ছেড়ে দিয়ে কিছু দিন কাজ করেন একটি ট্যুরিং কোম্পানিতে। কিন্তু সেখানেও তার মন টেকেনি। সেটিও ছেড়ে দিয়ে তিনি যুক্ত হন অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট রাইটার্স এসোসিয়েশনের সাথে। তখন নিজের জীবন এবং সমাজ জীবনে বয়ে যাচ্ছিল এক ভয়াবহ ঝঞ্চা। সেই ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ সময়েই শম্ভু মিত্র তার প্রথম নাটক লিখেন। শ্রীসঞ্জিব নামে।
তারপর লিখেছেন, আবৃত্তি করেছেন প্রাণ ভরে। তার উল্লেখযোগ্য নাটক হলো, নবান্ন, বিভাব, ছেঁড়া তার, দশচক্র, চার অধ্যায়, পুতুল খেলা, মুক্তধারা, কাঞ্চনরঙ্গ, বিসর্জন, রাজা অয়দিপাস, রাজা, বাকি ইতিহাস, পাগলা ঘোড়া ইত্যাদি। এছাড়াও আবৃত্তি করে সাঁড়া ফেলেছিলেন। করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালনাও। খাজা আহমেদ আব্বাস নির্মিত ধারতি কে লাল সিনেমায় কাজ করেছিলেন সহকারি পরিচলক হিসেবে। অভিনয়ও করেছেন মানিক, শুভ বিবাহ, ৪২, বউ ঠাকুরাণীর হাট ইত্যাদি চলচ্চিত্রে।