বাংলা ভাষার অপরাজেয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৪৫ তম জন্মবার্ষিকী আজ। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন তিনি 'অপরাজেয় কথাশিল্পী' নামে খ্যাত।
১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।পাঁচ বছর বয়সে মতিলাল দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি হয়ে দু-তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৯৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন তিনি। কলেজ ত্যাগ করার পর শরৎচন্দ্র ভাগলপুর শহরের আদমপুর ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও অভিনয় করে সময় কাটাতে শুরু করেন।
শরৎচন্দ্র ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে রেঙ্গুনে লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভগ্নিপতি উকিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে চলে যান। অঘোরনাথ তাকে বর্মা রেলওয়ের অডিট অফিসে একটি অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের ডেপুটি একজামিনার মণীন্দ্রনাথ মিত্রের সাহায্যে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে এই অফিসে চাকরি পান ও পরবর্তী ১০ বছর এই চাকরি করেন।
শরৎচন্দ্র বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে চাকরি করার সময় শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে জন্ম হয়, কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মারা যান। এরপরে তিনি মোক্ষদা নামের আরেক নারীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো- বড়দিদি, পল্লীসমাজ, দেবদাস, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, দত্তা, গৃহদাহ, পথের দাবী, পরিণীতা, নিষ্কৃতি, শেষ প্রশ্ন এবং শেষের পরিচয়। উপন্যাসের পাশাপাশি নাটকও লিখেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ষোড়শী, রমা, বিরাজ বউ ও বিজয়া।
তার সাহিত্যকর্মকে ঘিরে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্র বিভিন্ন ভাষায় তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি এবং তেলেগু ভাষায় আটটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পান। এছাড়াও তিনি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি পান। তিনি ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কালে কালে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অনেক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু শরৎ-এর মতো শব্দের দানা দিয়ে মানুষের জীবন চিত্র কেউ আঁকতে পারেনি। কল্পনার জগতে তিনি বাস্তবের একটা প্রতিচ্ছবি দেখতেন। আর রঙ তুলি ছাড়াই সে চিত্র আঁকতেন। যেখানে ফুটে উঠত মানুষ জীবনের হাসি কান্না দুঃখ বেদনা। আর প্রেম। সে তো তার কল্পনায় ভিন্নমাত্রায় ফুটে উঠেছে।
শরৎচন্দ্রের মতো হয়ত এমন ছবি কেউ আঁকতে পারেননি। সেজন্যই শরৎ আজও বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে অপরাজেয়। জীবদ্দশায়ই বিপুল সফলতা দেখেছেন। নিজের লেখা পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। এটা লেখককে তৃপ্তি ও আনন্দ দিয়েছে। প্রতিনিয়তই তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ সাহিত্য মানুষের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাহিত্যের মাঝে মানুষ যখন নিজের জীবনের চিত্র খুঁজে পান তখনই মানুষ সে সাহিত্য ধারণ করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সৃষ্টির ব্যাপারে সর্বদাই ছিলেন সচেতন এবং যত্নশীল। যা লিখেছেন তা রঙ-রূপ-রসে ভরিয়ে জীবন্ত প্রাণবন্ত করে পূর্ণতা দিয়েছেন।
আবার কেউ কেউ শরৎ-এর এমন লেখার বিরূপ সমালোচনাও করেছেন। তাদের ধারণা শরৎচন্দ্রের লেখার ভেতর শুধুই বেদনা। শরৎচন্দ্র শুধু মানুষকে কাঁদাতেই পেরেছেন। হাসাতে পারেননি। তার লেখায় দুঃখ বেদনার চিত্রটা বেশি ফুটে ওঠার একটা কারণ আছে। শরৎচন্দ্রের জীবনে দুঃখ বেদনাই ছিলো বেশি। সুখ তাকে স্পর্শ করেছে খুবই কম। হয়ত তার লেখায় নিজের অজান্তেই নিজের জীবন কাব্য ফুটে উঠেছে।