শৈল্পিক প্রতিবাদে সোচ্চার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ১, ২০২১, ০৮:১৯ পিএম

শৈল্পিক প্রতিবাদে সোচ্চার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশে শারদীয় দূর্গা উৎসবে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে সংস্কৃতিকর্মীরা। গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর সাংস্কৃতিক অঙ্গন সরগরম রয়েছে শিল্পীদের শৈল্পিক প্রতিবাদে। গান-কবিতা-নাটক-মাইম-নাচ যা কিছু সম্বল তাই যেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। শিল্প মাধ্যম ব্যবহার করে সহিংসতা বিরোধী সম্প্রীতির বার্তা দিচ্ছেন শিল্পীরা৷ 

সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও

‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’-এই স্লোগান নিয়ে রাজধানীতে মানববন্ধন করেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’। ২২ অক্টোবর (শুক্রবার) সকালে ধানমন্ডি ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

শারদীয় দূর্গোৎসবে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত এই মানবন্ধনে ছায়ানটের কর্মী-সংগঠকরা ছাড়াও জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলন, ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন, নালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সংগঠন ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে অংশ নেয়। মানববন্ধনের পুরোটা সময় সমবেত কণ্ঠে দেশাত্মবোধক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান পরিবেশন করেন তারা। মানববন্ধনে অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান, ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা, শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, শিল্পী বুলবুল ইসলাম, শিক্ষক হাফিজুর রহমান প্রমুখ।

মানববন্ধন শেষে ছায়ানটের কার্যনির্বাহী সভাপতি ড.সারওয়ার আলী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। যে কারণে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে পারেনি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশে ধর্মান্ধ শক্তির স্থান নেই। তাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে পরিত্রাণের জন্য বাঙালি সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের একান্ত প্রয়োজন। একইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখে দিতে দেশবাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সহিংসতা বিরোধী কনসার্ট 

দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সহিংসতাবিরোধী কনসার্টের আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ২২ অক্টোবর (শুক্রবার) বেলা আড়াইটায় কনসার্টটি শুরু হয় ৷ ‘সহিংসতার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কনসার্টের আয়োজন করেছে। শিল্পের মাধ্যমে দেশবাসীকে সহিংসতা প্রতিরোধের বার্তা দেওয়া কনসার্টের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা।

কনসার্টে গান পরিবেশন করে গানের দল শিরোনামহীন, মেঘদল, সহজিয়া, শহরতলী, বাংলা ফাইভ, গানপোকা, কৃষ্ণপক্ষ, কাল্, অবলিক, অসৃক, গানকবি ও বুনোফুল৷ এছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করবেন জয় শাহরিয়ার, তুহিন কান্তি দাস, সাহস মোস্তাফিজ, লালন মাহমুদ, নাঈম মাহমুদ, প্রিয়াংকা পাণ্ডে, যশ নমুদার, তাবিব মাহমুদ, রানা, উদয়, অপু, উপায় ও অনিন্দ্য৷

নৃত্য পরিবেশন করবেন উম্মে হাবিবা ও আবু ইবনে রাফি৷ আয়োজনে মূকাভিনয় পরিবেশন করবে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন। এ ছাড়া ছিল একটি সমবেত ‘থিমেটিক পারফরম্যান্স’৷

পথ ছেড়ো না পথের মানুষ 

সারাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে নাটক,আবৃত্তি এবং সম্প্রীতির গান পরিবেশন করেছে প্রাচ্যনাট ও তার বন্ধুরা। ৩০ অক্টোবর(শনিবার) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ এ আয়োজনটি। অনুষ্ঠানে পথনাটক, পারফরম্যান্স আর্ট, ইন্সটলেশন আর্ট, আবৃত্তি এবং সম্প্রীতির গান পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানে নাটকের দল, গানের  দল ,আবৃত্তিকার, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রাচ্যনাটের আয়োজন। ছবি: সংগৃৃহীত

এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছে প্রাচ্যনাট, বাতিঘর,বটতলা, থিয়েটার ৫২,বুনোফুল,প্রীতিলতা ব্রিগেড, মাইম অ্যাকশান(ঢাবি),বৈকুন্ঠ,স্রোতসহ আরও অনেকেই।

ঐতিহ্য ও কৃষ্টির এই দেশে থাকি সবাই মিলেমিশে

১৫টি সংগঠনের মোর্চা ‘ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন’ (এফটিপিও)-এর নেতৃত্বে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমাবেশ করে শিল্পী ও কলাকুশলীরা। অন্তর্ভুক্ত সংগঠন ছাড়াও এতে সামিল হয়ে সংহতি প্রকাশ করে সংগীত মোর্চা ‘সংগীত ঐক্য বাংলাদেশ’, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পথ নাটক পরিষদ, আবৃত্তি পরিষদ, নৃত্য শিল্পী সংস্থা, নৃত্যাঞ্চল, বাচসাসসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।

চলচ্চিত্র ও নাট্য কলাকুশলীদের সমাবেশ। ছবি: দ্য রিপোর্ট

সম্প্রীতি সমাবেশের প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে উক্ত সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন প্রযোজক-অভিনেতা ইরেশ যাকের এবং সদস্য সচিব সঞ্চালক-নির্মাতা আনজাম মাসুদ, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, গাজী রাকায়েত, ইরেশ যাকের, আহসান হাবিব নাসিম, চয়নিকা চৌধুরী, তারিন জাহান, আনজাম মাসুদ, সুমন আনোয়ার, মীর সাব্বির, মাসুম রেজা, শমী কায়সার, রাশেদ মামুন অপু, শিবলী মোহম্মদ, নাদিয়া আহমেদ, শিহাব শাহীন, হারুন অর রশিদ, শাহেদ আলী, দীপা খন্দকার, আজাদ আবুল কালাম, জয়শ্রীকর জয়া, সাব্বির, সন্দীপন, শুভ, পুলক, সমরজিৎ রায়, সাকী আহমেদ, রবিউল ইসলাম জীবনসহ অনেকে।

এই সম্প্রদায়িকতাকে নিজেদের ব্যর্থতা বলে মেনে নেন এফটিপিওর চেয়ারম্যান নাট্যজন মামুনুর রশীদ। সংসদ ভবনের সামনে টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমাবেশে যোগদিয়ে তিনি তার বক্তব্যে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন হলো এদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে। আমরা সেই ষড়যন্ত্রকারীকে নির্মূল করতে চাই। আশ্চর্যের বিষয়, আজকে এতদিন হয়ে গেলেও তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। আমি এই হামলার দায় স্বীকার করি। কারণ সাংস্কৃতিক কর্মীরা তারা তাদের কাজ করতে পারেনি। করতে পারলে সাম্প্রদায়িকতা এদেশে থাকত না। এ দায় আমাদেরই।

দেখতে কি পাও, পুড়ছে বাংলা 

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও সারাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ ১৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) এক প্রতিবাদী পরিবেশনার আয়োজন করে। 'গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হয়ে আসুন সকলে' শিরোনামে পরিবেশনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অপরাজেয় বাংলা'র পাদদেশে সকাল ১১ ঘটিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কর্তৃক আয়োজিত 'মানববন্ধন' এর সাথে একত্রিত হয় এবং 'সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাষ্কর্য' এর পাদদেশে দুপুর ১২টায় প্রদর্শন করা হয়। 

রুখে দাও ধর্ম সন্ত্রাস

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে রুখে দাও ধর্ম সন্ত্রাস শীর্ষক কর্মসূচি আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ।

২৩ অক্টোবর(শনিবার) সকাল থেকে টিএসসি প্রাঙ্গণে গণস্বাক্ষর এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ঘটনার ৩৪টি ছবি নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে সংগঠনটি।

বিকেল ৪টা থেকে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাংস্কৃতিক আয়োজন 'ভিটে মাটির গান' বিষয়কব পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করে গানপোকা, বক্ররেখা, বুনোফুল গানের দল এবং নাঈম মাহমুদ ও লিসান।

ভিটেমাটির গান, টিএসসি প্রাঙ্গণ,ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। ছবি: সংগৃহীত

এছাড়া প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র(টিএসসি) প্রাঙ্গণে রাত ৯টা থেকে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত 'চিত্রা নদীর পাড়ে' চলচ্চিত্রের উন্মুক্ত প্রদর্শনী হয়।

কুমিল্লা, চাঁদপুর এবং রংপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে রাজধানীতে শিল্প মাধ্যমের প্রতিবাদ নেটিজেনদের ভালবাসা কুড়িয়েছে। আবার সমালোচনা রয়েছে শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ এই প্রতিবাদের আয়োজনকে ঘিরে।

Link copied!