ঢাকার কূটনীতিক পাড়ায় আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন যারা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ৩১, ২০২২, ১২:২৭ এএম

ঢাকার কূটনীতিক পাড়ায় আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন যারা

বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যে ২০২২ সালের প্রায় পুরো সময়ই সরব ছিল ঢাকার অভিজাত কূটনীতিক পাড়া। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সেমিনারে দেশের নির্বাচন, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে ও মন্তব্য করে এসব কূটনীতিক বেশ সমালোচিত হয়েছেন। সরকারও এক সময় এসব কূটনীতিকদের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। তারপরও ওইসব ইস্যুতে বছর জুড়ে কূটনীতিকদের তৎপরতা ছিল  চোখে পড়ার মতো।

১. ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি

জাপান বাংলাদেশের ঘনিষ্ট বন্ধু। দেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী দেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে জাপানি অর্থ সহায়তা পেতে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করে সদ্য বিদায় নেওয়া রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তবে গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীতে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি এক কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার বহির্ভূত মন্তব্য করে সমালোচিত হন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)  ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ শীর্ষক ওই মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের  জবাবে ইতো নাওকি বলেন, “আমি শুনেছি, (২০১৮ সালের নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। আমি আশা করবো, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।” অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।  

২. দেশের নির্বাচন নিয়ে জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার

বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু  নির্বাচন এবং মানবাধিকার ইস্যুতে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির রাষ্ট্রদূতই বেশি সোচ্চার ছিলেন। ভিয়েনা কনভেনশনে গৃহীত চুক্তির প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য দিয়েছেন।

বোশি সমালোচিত হয়েছেন গত ১০ অক্টোবরে দেওয়া তার এক বক্তব্যে। ওইদিন এক সভায় ট্রোস্টার বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মানে হচ্ছে নিয়মিতভাবে অবাধ ও সুস্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন। এ ধরণের  নির্বাচন দেশের স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি ভোটারদের ভেঅট দেয়ার  এবং সরকার গঠেনে ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে। তাই সমালোচিত হলেও বন্ধু হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা আমি বলে যাবো।”

এর দুইদিন পর আবারও সরব হন তিনি। গত ১৩ অক্টোবর এক সেমিনারে সহিংস রাজনীতি দেশের মানুষের কোনো কাজে আসে না বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশে ঝামেলা বাড়তে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা।”

৩. নিখোঁজ ব্যক্তির বোনের বাসায় যাওয়া নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত 

একাধিক কারণে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ছিলেন ঢাকার কুটনীতিক পাড়ায় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার পাত্র। গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের পরদিন নিজের ফেসবুক পোস্টে পিটার হাস বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতা ও ভয়ভীতি দেখানোর খবরে আমরা উদ্বিগ্ন। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা সবার প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

এর আগে, ৩১ মে এক সেমিনারে তিনি তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।”

তবে বিএনপি’র  নিখোঁজ হওয়া এক ব্যক্তির আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার ঘটনা এবং ফেরার পথে তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করছে বলে সমলোচনা করে রাশিয়া।

গত ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির নিখোঁজ হওয়া নেতা সাজেদুল ইসলামের বোন ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের সংগঠন  ‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়কের বাসয় যান। সাক্ষাত শেষে ফেরার পথে ‘মায়ের কান্না’ নামে আরেকটি সংগঠনের লোকজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন। ওই ঘটনায় নিরাপত্তার উদ্বেগ জানাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যান। পরদিন এনিয়ে উদ্বেগ জানাতে ওয়াশিংটনে ‍নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনা নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

৪. ঢাকায় মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার

গত ৬ নভেম্বর ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার।

এদিন সাংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা মিশন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএসএআইডি বাংলাদেশ কার্যালয় আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ  করতে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গে নিবিঢ়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।”

৫. বিরোধী দলের সমাবেশ ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র

বাংলাদেশে বিরোধী দলের সভাসমাবেশে আইনশৃঙ্খলা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলা ভাঙচুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস গত ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে কড়াকড়ি আরোপের ঘটনা নিয়ে তার দেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থীকে হুমকি, উত্তেজনা অথবা এক দল বা প্রার্থীর ওপর যাতে সহিংসতা ঘটতে না পারে বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা সরকারের কাছে আহবান জানাচ্ছি।

ব্রিফিংয়ে তিনি আরও  বলেন, “অর্থপূর্ণ নির্বাচন করতে হলে সহিংসতা, হয়রানি ও নির্ভয়ে ভোটারদের সঙ্গে প্রার্থীদের জনসংযোগ করার সুযোগ করে দিতে হবে।”

৬. ‘শিষ্টাচার বহির্ভূত’ বিবৃতি দিয়ে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক

২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে গত ৭ ডিসেম্বর বিকেলে দেওয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রহিসেবে মতপ্রকাশ, গণমাধ্যম ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে অঙ্গীকারের কথা বাংলাদেশকে স্মরণ করিয়ে দেন।

নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের এক ঘন্টা পর পরই তিনি ওই বিবৃতি দেন। তার এই বিবৃতি কূটনীতিক পাড়ায় ও বিশ্লেষকদের কাছে বেশ সমালোচিত হয়। 

৭. নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্নে ইইউ ও ১৪ টি দেশের মিশন প্রধান

নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ১৪টি দেশের মিশন প্রধান গত ৬ ডিসেম্বর বলেন, “আমরা বাংলাদেশের বন্ধু ও উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পূণর্ব্যক্ত করছি।”

মিশনগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া।

৮. ঢাকায় পিটার ডি হাস ইস্যুতে ওয়াশিংটন-মস্কোর বিবৃতি যুদ্ধ

চলতি মাসের গত ১৪ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলামের বোনের বাসায় গিয়ে স্বজনদের সাথে সাক্ষাত শেষে ফেরার পথে একদল লোক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন এবং তাঁর গাড়ির গতিও রোধ করেন। পরে নিরাপত্তারক্ষীদের সহায়তায় নিরাপদে শাহীনবাগ ত্যাগ করে সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এ ঘটনায় ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন তৈরি হয়।

এরই মধ্যে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয় তুলে ধরে গত ২২ ডিসেম্বর মস্কোয় বসে বিবৃতি দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। সেখানে তিনি বলেন, “এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের শামিল।”

রুশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, “গণতন্ত্র সুরক্ষা বা অন্য অজুহাতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে রাশিয়া বদ্ধপরিকর। তবে একদিন পরই পাল্টা জবাবে ঢাকায় মার্কিন দূতবাস প্রশ্ন তোলেন-ইউক্রেনের ক্ষেত্রে রাশিয়া এই নীতি প্রয়োগ করেছে কী না?

এর একদিন পর জবাবে রুশ দূতাবাস টুইটারে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র যে পশ্চিমা বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছে তা তুলে ধরা হয় ওই ব্যঙ্গ চিত্রে।

৯. নির্বাচন ইস্যুতে মন্তব্যে সমালোচনার ঝড়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার

২০২২ সালের বিভিন্ন সময়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাসহ নানা ইস্যুতে মন্তব্য করা ও বিবৃতি দিয়ে আলোচনা–সমালোচনায় ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঢোকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ( ডিআরইউ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ডিকসন বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতো যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়াসহ বহুদলীয় ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র দেখতে চায়।” এটি ভিয়েনা কনভেনশনে গৃহীত চুক্তির  স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সমালোচনা করেন।

১০. তুর্কি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রশংসা ছিল কূটনীতিক পাড়ায়

নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা যখন ভিয়েনা কনভেনশন রীতিকে তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ সরকার, ইসিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেন, তখন ব্যতিক্রম ছিলেন তুর্কি রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান।

গত ১৬ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সরকার, রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে। অন্য কোনো দেশের ওপর নয়।” সত্য কথা বলায় তুর্কি রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্য প্রশংসা পায় কুটনীতিক পাড়ায়।

Link copied!