আরও একটি বছর শেষ হচ্ছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে যোগ হচ্ছে নতুন বছর ২০২৩। বিদায়ী বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতেও। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় ডলার-সংকট। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাজারেও। আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে ওঠে মূল্যস্ফীতি।
ইসলামি ধারার ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম
ইসলামি ধারার তিনটি ব্যাংক থেকে রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রুপকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানকে যে ঋণ দেয়া হয় তা যাচাই-বাছাই না করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে নাবিল গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে এই ঋণ নেয়া হয়েছে অন্য কোনো পক্ষকে সুবিধা দেয়ার জন্য।
১১ বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি
মূল্যস্ফীতিই সদ্য বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে সামনে এসেছে। গত আগস্টে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ। আগস্টে মাসে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে অবশ্য অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯১ এবং ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধি
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার গত ৫ আগস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ হার দেশে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
ডলার-সংকট ও রেকর্ড দাম
চলতি বছরে ব্যাংক খাতে আলোচিত ঘটনা ছিল ডলার-সংকট। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় এ-সংকট আরও তীব্র হয়। তাতে খোলাবাজারে সেঞ্চুরি হাঁকায় ডলার। ব্যাংক খাতে কয়েক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০৮ টাকায়।
রিজার্ভে চাপ
ডলার-সংকট সামাল দিতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি ও খাদ্যপণ্যের আমদানি দায় মেটাতেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। এর ফলে কমে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। চলতি বছরে রিজার্ভ ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার থেকে কমে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ঘরে নেমেছে। বৃহস্পতিবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার।
সোনার দামে রেকর্ড
সোনার দামের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি ঘটে চলতি বছর। গত ৪ ডিসেম্বর সোনার দাম বেড়ে ভরিপ্রতি দাঁড়ায় ৮৭ হাজার ২৪৭ টাকা। এটিই দেশের ইতিহাসে সোনার সর্বোচ্চ দাম। এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৪ হাজার ৫৬৪ টাকায়। এবার সে রেকর্ডও ভাঙল।
মাথাপিছু আয় এখন ২,৮২৪ ডলার
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৩৩ ডলার। গত পাঁচ বছরে এ দেশের মাথাপিছু আয় ৩৮ শতাংশের বেশি বেড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে থেকে একটি দেশে যত আয় হয়, সেটিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়।
১১ বছর পর জনশুমারি
১১ বছর পর দেশের জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য বের করতে জনশুমারি হয়েছে। গত জুনে এ শুমারি হয়। সর্বশেষ জনশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। অর্থনীতি বা উন্নয়নের যেকোনো নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনশুমারির তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনশুমারির তথ্য মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন।
বিদেশ সফর ও আমদানিতে কড়াকড়ি
ডলার-সংকটের কারণে সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় গত মে মাসে। এ ছাড়া চলতি বছর কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পাশাপাশি নানা রকমের ফলমূল, প্রসাধনী আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে গত ১২ জুলাই যোগদান করেছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই অর্থসচিবের দায়িত্ব নেয়ার আগে অর্থ বিভাগে ১৮ বছরেরও বেশি সময় কাজ করেছেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
প্রথম নারী অর্থসচিব
গত ১৬ জুন নতুন অর্থসচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন। তিনিই দেশের প্রথম নারী অর্থসচিব। দেশের প্রথম নারী ইআরডির সচিবও তিনি। বিসিএস নবম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মচারী ফাতিমা ইয়াসমিন ইআরডির সচিব হওয়ার আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
অর্ধেকে নেমেছে এলসি খোলার পরিমাণ
দেশের রিজার্ভকে সংরক্ষণে পণ্য আমদানিতে নানা শর্তারোপের কারণে এপ্রিল থেকে টানা কমতে কমতে ছয় মাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে এলসি খোলার পরিমাণ। চলতি বছরের মার্চে এলসি খোলা হয়েছে ৯.৮০ বিলিয়ন ডলারের। সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা হয়েছে ৬.৫১ বিলিয়ন ডলারের। অক্টোবরে এসে বড় ধরনের পতন হয়েছে। এ মাসে এলসি খোলা হয়েছে ৪.৭২ বিলিয়ন ডলারের।