কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃজনশীলতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে কুমিল্লা। তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও রচিত হয়েছে এ জেলাতে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাব আর বেদখলের কারণে কুমিল্লা ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবির অনেক স্মৃতিচিহ্নও এখন বিলুপ্তির পথে। যা কিছু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে সেটাও বেশ অবহেলা-অনাদরে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ সংলগ্ন রানীর দীঘির পাড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে বসে কবি গান ও কবিতা চর্চা করতেন। এ ছাড়া জাতীয় কবির অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে কুমিল্লার নগরী ও মুরাদনগরের দৌলতপুরের মাটির সঙ্গে। যা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে নেই কোনো স্মৃতিফলকও।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লা নগরীতে স্থাপিত ১২টি স্মৃতিফলক এ বছর সংস্কার করা হয়েছে। নজরুলের প্রেম, বিয়ে-বিচ্ছেদ, গ্রেপ্তার ও কাব্যচর্চাসহ বহু ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ১৯৮৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিলো স্মৃতিফলকগুলো।
নজরুলকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণার জন্য কুমিল্লার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল উদ্বোধন হওয়া নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র নিয়েও ক্ষোভের শেষ নেই কবিপ্রেমিদের। অনেকে বলেছেন, যে অর্থে কুমিল্লায় নজরুল ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছিল, সেই অর্থে এটির ব্যবহার হচ্ছে না। পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় এখানে অনেক কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। হচ্ছে না নজরুলকে নিয়ে গবেষণা।
কুমিল্লার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, “অনেকে বলছেন, পাঁচ দফায় কবি ১১ মাস কুমিল্লায় ছিলেন। কিন্তু আমার গবেষণায় দেখেছি, কবি এক বছরের বেশি সময় কুমিল্লায় অবস্থান করেছেন। কুমিল্লাতে তিনি ৫৩টি রচনা, কবিতা, গান লিখেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে; যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই।
কুমিল্লা নজরুলের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, “কুমিল্লাকে বাদ দিয়ে কবির জীবনী রচনা করা যাবে না। কবির জীবনের প্রথম অনেক কিছুই ঘটেছে কুমিল্লায়। কবি প্রথম প্রেম ও বিয়ে করেছেন কুমিল্লায়, দ্বিতীয় বিয়েও কুমিল্লায়।”
আলী হোসেন চৌধুরী আরও বলেন, “নজরুল কুমিল্লার অহংকারের জায়গা। তবে কুমিল্লায় নজরুলের অনেক স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে নজরুল ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছিল তার মোটেও প্রতিফলন নেই। এখানে নজরুলকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে না।”
“এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত কবির নামে কুমিল্লায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়নি। যা আমাদেরকে খুবই কষ্ট দেয়। তবে এবার ১২৩তম জন্মজয়ন্তী জাতীয়ভাবে কুমিল্লায় উদযাপিত হচ্ছে, এজন্য আমরা খুবই আনন্দিত। আমি মনে করি, প্রতি বছরই এই অনুষ্ঠান কুমিল্লায় হওয়া উচিত।”
কুমিল্লার আরেক শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক অধ্যাপক শান্তি রঞ্জন ভৌমিক বলেন, “কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে এখন পর্যন্ত যেটুকু কাজ হয়েছে, তার প্রায় সবটুকুই হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। বৃহত্তর কুমিল্লার সন্তানরাই নজরুলকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করেছেন।”
“নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র স্থাপনের পর আমাদের বিশ্বাস ছিল গবেষণার মাধ্যমে কুমিল্লায় নজরুলকে অকৃত্রিমভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। নজরুল ইনস্টিটিউটে শুধু সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু নজরুলকে নিয়ে কোনো গবেষণা হয় না। নজরুল পরিষদে এমন অনেকেই দায়িত্ব পালন করছেন, যারা আসলে নজরুল সম্পর্কে কিছুই জানেন না এবং বোঝেনও না।”
এই গবেষক আরও বলেন, “কবি ১১ মাসের মধ্যে কুমিল্লা শহরে নয় মাস আর মুরাদনগরে ছিলেন দুই মাস। নজরুলের স্মৃতিচিহ্নগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। যারা শুধু চাকরির জন্য নয়, নজরুলকে ভালবেসে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করবেন।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, এ বছর জাতীয় কবির ১২৩তম জন্মজয়ন্তী জাতীয়ভাবে কুমিল্লায় পালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা কুমিল্লায় যতগুলো স্থানে কবির স্মৃতিফলক রয়েছে, তার সবগুলো সংস্কার করেছি।
“নজরুল ইনস্টিটিউটে কবিকে নিয়ে গবেষণা কম হচ্ছে, এটা সত্য। তবে কবিকে নিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠান যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে থাকে। এরপরও আমরা এ বিষয়ে আরও উদ্যোগ নেব।”
গবেষকরা জানান, কবির দুই জীবনসঙ্গীর প্রথমজন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খাঁবাড়ির আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিস আসার খানম আর অপরজন কুমিল্লা নগরীর বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা দুলী। তবে কবি তাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা।