২০২০ সালের জুলাই মাসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের পুলিশ একটি সন্দেহজনক ফেসবুক পেইজের সন্ধান পায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই পেইজটি পুলিশের নজরে আনে। সংস্থাটির দাবী, পেইজটি থেকে শিশুদের ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছিল। এবং এসব ছবি ও ভিডিও শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনকে উস্কে দিচ্ছিল। পরে স্থানীয় পুলিশ বিষয়টির উপর প্রায় ১ মাস তদন্ত করে প্রদেশের রাজধানী গৌহাটি থেকে ২৮ বছরের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশের দাবী, আটক ওই ব্যক্তির মোবাইল ফোনে শিশুদের যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে এমন কিছু ভিডিও ছিল। আসাম পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা গীতাঞ্জলী দোলে বলেছেন, ওইসব ভিডিও দেখার পর অনেক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি।
পুলিশ আরো বলছে, ওই ব্যক্তি তার পেইজের মাধ্যমে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনে উদ্বুদ্ধ করে এমন ভিডিও ও ছবি বিক্রি করছিল। তবে, লোকটি এর মাধ্যমে কিভাবে লাভবান হচ্ছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে, পুলিশ তাকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আগেই গ্রেপ্তার করেছে। পেইজটি ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং আদালতে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে।
তবে বর্তমানে জামিনে থাকা ওই ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, তিনি কখনো শিশুদের যৌন নির্যাতনে উৎসাহ দেয় এমন কোন ভিডিও ডাউনলোড করেননি। শেয়ারও করেননি, এমনকি সেরকম কোন আধেয়ও কখনো পানও কারো কাছ থেকে।
বিশ্বের সব দেশের মধ্যে ভারতেই শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। ২০২০ সালে দেশেটিতে অন্তত ৪৩ হাজার শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো। সেই হিসাবে প্রতি ১২ মিনিটে ১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
তবে, সচেতন সমাজের ধারণা প্রকৃত সংখ্যা এই সংখ্যার চেয়ে আরও অনেক বেশি। কেননা অনেক শিশু এবং তার পরিবার সামাজিক এবং লোকলজ্জার ভয়ে অনেক সময় এই বিষয়টি লুকিয়ে যান।
ভারতের আইন অনুসারে দেশটিতে শিশুরা যৌন নিগ্রহের শিকার হতে এমন কোন আধেয় প্রকাশ, সম্প্রচার এবং ছড়িয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ কিন্তু সেটা কার্যকর হতে পারেনি। এবং করোনা ভাইরাসের মহামারীর সময়ে এধরণের আধেয়র বিস্তার আরও বহুগুণে বেড়ে গেছে।
মানবাধিকার কর্মী এবং পুলিশের সূত্র মতে, গত বছরে করোনা জরুরী অবস্থা ও লকডাউনে ঘরে অলস বসে থাকার সময় শিশুদের যৌন নিগ্রহ করা হচ্ছে এমন আধেয়র অনলাইন চাহিদা এবং ছড়িয়ে পড়ার হার মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কেরালার পুলিশের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাইবার সেল ‘সাইবারড্রোম’ প্রধান মনোজ আব্রাহাম জানাচ্ছেস, কেরালায় শিশুদের যৌন নিগ্রহের আধেয় ছড়িয়ে পড়ার হার ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।
মনোজ আব্রাহাম আরো বলছেন, করোনা মহামারী স্থানীয়ভাবে শিশুদের যৌন নিগ্রহের ভিডিও নির্মাণের হার বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা চেপে যাওয়া হচ্ছে। কেননা, শিশু যার দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই পরিবারেরই পরিচত অথবা আপনজন। এবং এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়। পরিবারের সদস্য দ্বারাই শিশুটি নিগৃহীত হচ্ছে।
ভারতের অন্য রাজ্যের অবস্থাও একইরকম। খুব বেশি আলাদা নয়।
ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রটেকশন ফান্ড নামের একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে যে, দেশটির রাজধানী দিল্লী, মুম্বাইসহ অন্তত ১০০ টি শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে শিশুদের যৌন নিগ্রহ করা হচ্ছে এমন ভিডিওর চাহিদা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা বলছে, এসব আধেয় যারা দেখছে তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ১ শতাশ নারী। বাকী ৯ শতাংশকে চিহ্নিত করা যায়নি।
এদের মধ্যে অধিকাংশই ‘স্কুলগামী নারী শিক্ষার্থী’ এবং ‘টিনেজ’ শিরোনামের যৌন ভিডিও বেশি দেখেছে। এসব ব্যবহারকারীদের অনেকেই ভিপিএন ব্যবহার করে এসব ভিডিও দেখেছে।
বিষজ্ঞরা এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বলছেন, “এটি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয় যে, শিশুরা এবং শিশুদের যৌন নির্যাতনকারীরা (পেডোফিল) দীর্ঘ সময় অনলাইনে থাকায় তারা শিশুদের ফাঁদে ফেলার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে, শিশুদের যৌন নিগ্রহের ভিডিও নির্মাণ ও ছড়িয়ে পড়ার হার ক্রমশ বাড়ছে।
পুনের কেইএম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মনোবিজ্ঞানী ড. বাসুদেব পারালিকার বলছেন, “লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে যেখানে একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা, অনিশ্চিয়তার ঝুঁকি এবং সম্ভবত ক্রমবর্ধমান বিরক্তি বিদ্যমান সেখানে মানুষের চিন্তা যৌনতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা মেটাবার কোন স্বাস্থ্যকর উপায় না থাকায় মানুষ এসব অনলাইন আধেয়র দিকে ঝুঁকছে।”
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন যে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং অনলাইন ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে শিশুদের যৌন নির্যাতনকারীদের শিশুদের যৌন নিগ্রহ করতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এমনকি শিশুদের যৌন নির্যাতনে ব্যবহৃত সামগ্রীর সরাসরি সম্প্রচার, প্রকাশ এবং বিতরণ
একইসঙ্গে শিশুদের হারিয়ে যাওয়া এবং নিগ্রহ নিয়ে কাজ করা যুক্তারষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইবার ট্রিপলিন ২০২০ সালে, সারা বিশ্ব থেকে শিশুদের যৌন নিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্তত ২ কোটি ১৭ লাখ ছবি, ভিডিও এবং অন্যান্য অধেয়র ব্যাপারে রিপোর্ট পেয়েছে। যা কিনা আগের বছর অর্থাৎ, ২০১৯ সালের চেয়ে ২৮ গুণ বেশি। এবং সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট পাওয়া গেছে ভারত থেকে।
মুম্বাইভিত্তিক মানবাধিকারকর্মী সিদ্ধার্থ পিল্লাই গত আগস্টে ১৬ বছর বয়েসী এক কিশোরের সাথে আলাপ করে বিষয়টি ধরতে পারেন। কিশোরটি তাকে বেশ কিছু চ্যাট দেখায়, যা তাকে তার ১০ বছর বয়েসি বোন দিয়েছিল। তা থেকে সিদ্ধার্থ বুঝে যান ওই কিশোরের ১০ বছর বয়েসী বোনকে কেউ অনলাইনে প্রলুব্ধ করছে।
আরম্ভ নামের প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত সিদ্ধার্থ জানাচ্ছেন, এই প্রলুব্ধকরণ শুরু হয় একটি অনলাইন গেমসের মাধ্যমে। তার তা সেখান থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে আসে।
প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন থেকে যৌন নিগ্রহের শিকার ভিকটিমদের ছবি, ভিডিওসহ সব ধরণের আধেয় সরিয়ে নিতে কাজ করে থাকে।
সিদ্ধার্থ আরও জানাচ্ছেন, এটি প্রথমে সাধারণভাবে হাই হ্যালো দিয়েই শুরু হয়। এবং তারপর ক্রমশ নানারকম চাটুকারিতা দিয়ে আগাতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তা যৌনতার দিকে আগায়।
সিদ্ধার্থর মতে, এটি একজন শিশুকে ‘প্রলুব্ধ করার’ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ‘ক্ল্যাসিক পদ্ধতি’। যেখানে প্রলুব্ধকারী শিশুকে যৌন উত্তেজক ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে।
কর্মকর্তারা বলছেন, আগে এধরণের বিষয়গুলো ডার্ক ওয়েবে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তখন বিট কয়েন দিয়ে লেনদেন হতো। কিন্তু বিষয়গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং স্থানীয় মুদ্রার মাধ্যমেই লেনদেন হচ্ছে।
কেরালা পুলিশ ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে এই বিষয়টিক ট্যাকল করার জন্য। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সফটওয়্যার দিয়ে বিভিন্ন পর্ন সাইট ব্লক করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে, প্রায় দেড় হাজার জনকে তল্লাশি এবং ৩৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
বৈশ্বিক থিংকট্যাংক ‘সাইবার পিসে’র বিনীত কুমার বলছেন, কেরালার মতো ভারতের অন্যান্য শহর এই বিষয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ফলে তারা দুষ্কৃতিকারীদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে।
মানাবাধিকারকর্মীরা আরও বলেন, ভারতের সমাজে পেডোফিলিয়া এবং শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে অনেক বাধা রয়েছে। ফলে আসল সমস্যা খুঁজে বের করা অতোটা সহজ নয়।
আপাত সমাধান হিসেবে, কেরালা পুলিশের সাইবার সেলের প্রধান মনোজ আব্রাহামের পরামর্শ হলো, বাবা মার উচিৎ তাদের সন্তান অনলাইনে কি করছে সে বিষয়ে সতর্ক জারি রাখা।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ:
শিশুদের যৌন নিগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রটা কেমন?
ভারতের মতো অতোটা আশঙ্কাজনক না হলেও বাংলাদেশেও এর বিষবীজ রয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত, ৬২৬ জন শিশু নানাভাবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৪৫ জন শিশু ধর্ষণের কারণে মারা গিয়েছে। ফলে, অবস্থা যে এই ক্ষেত্রে ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে শিশুরা অনেকক্ষেত্রে নিজের পরিবারেও নিরাপদ নয়। কেননা, শিশু নিগ্রহের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় কোন না কোন পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কিংবা প্রতিবেশির সহায়তা করেছে। সুতরাং, এক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতে পরিস্থিতি একই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
তারচেয়েও বড় কথা হলো, ভারতের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের যৌন নিগ্রহ নিয়ে সমাজে অনেক বাধা রয়েছে। যেগুলো কাটিয়ে উঠে অনেক নির্যাতন আলোয় আসতে পারে না। চাপা পড়ে যায় গভীর অন্ধকারে।
২০২০ সালে অন্তত ১৪৫ শিশু যৌন নির্যাতনের হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে আবার, ৩৪ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজেদের জীবন নিয়ে নিয়েছে।
ফলে, দুই প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ এবং ভারতের শিশুদের যৌন নিগ্রহের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংখ্যায় ফারাক থাকলেও পরিস্থিতি প্রায় একইরকম। এই দুই দেশেই শিশুরা অনেকটা অনিরাপদ জীবন যাপন করে।
ভারতের ক্ষেত্রে এধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে করোনা মহামারী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ এবং ভারতে করোনার তীব্রতা কমে গিয়ে মানুষ অনেকটা স্বাভাবিক কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরেছে। তবে পেডোফিলিয়ার মতো মানসিক বৈকল্যকে আমলে নিয়ে এর চিকিৎসা এবং শিশুদের নিগৃহীত হওয়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণ খুঁজে বের করার জন্য বড় পরিসরে সামাজিক গবেষণা এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। আশা করা যায়, বাংলাদেশে এই সমস্যা আরো ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিরাময় করা যাবে।