৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্ক আর সিরিয়া যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নিহতদের নিয়ে ফরাসি ব্যঙ্গবিষয়ক ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর একটি কার্টুন যেন সবাইকে অবাক করে দিলো। এমন ভয়াবহ অবস্থায় যেখানে বিশ্বব্যাপী সবাই শোকপ্রকাশ করে সমবেদনা জানাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সর্বোচ্চ সাহায্য করার ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে এসেছে সে সময় এই কার্টুন বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
শিল্পী পিয়েরিক জুইনের আঁকা কার্টুনটিতে দেখা যায়, ধসে পড়া ভবন, উল্টে যাওয়া একটি গাড়ি ও ধ্বংসস্তূপের পাহাড়। সাথে ক্যাপশন লেখা- তুরস্কে ভূমিকম্প, সেখানে ট্যাংকও পাঠাতে হয়নি।
এই কার্টুন নিয়ে সারা বিশ্বেই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা বলেছেন, কার্টুনটি লাখ লাখ মানুষের বিপর্যয়কে উপহাস করেছে। কেউ কেউ এই অঙ্কনটিকে ‘জঘন্য’, ‘লজ্জাজনক’, ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘বিদ্বেষাত্মক বক্তব্য’ বলে অভিহিত করেছেন। সারা আসাফ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, তিনি পত্রিকাটির প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করছেন। ‘জে নে সুইস প্লাস শার্লি’ (আমি আর শার্লি নই)।
বর্ণবাদী এবং প্রচণ্ড ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন হিসেবে আগে থেকেই ‘পরিচিতি’ রয়েছে শার্লি এবদোর। সোমবার তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার কয়েক ঘণ্টা পর নিজেদের টুইটার হ্যান্ডেলে ‘কার্টুন অব দ্য ডে’ প্রকাশ করে ম্যাগাজিনটি।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন এক টুইটবার্তায় নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘আধুনিক বর্বর! তোমাদের ক্ষোভ আর ঘৃণায় ডুবে মরো।’
এদিকে লন্ডনে একে পার্টির প্রতিনিধি ও একজন তুর্কি রাজনীতিবিদ আব্দুর রহিম বোনুকালিন বলেন, বিতর্ক জন্ম দিতে তাদের কোনো সীমা নেই।
শার্লি এবদো এর আগেও অনেকবার এভাবেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
‘শার্লি এবদো’র যাত্রা শুরু কীভাবে
শার্লি এবদো ১৯৬০ সালে যখন যাত্রা শুরু করে তখন এর নাম ছিল হারা-কিরি ম্যাগাজিন। জর্জিস বার্নিয়ার প্রকাশনা পরিচালক হিসেবে এবং ফ্রান্সেস ক্যাভান্না সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে এই মাসিক পত্রিকাটি চালু করেন।
শুরুর দিকে হারাকিরির জনপ্রিয়তা পেতে সময় লেগেছিল। কিছুদিন পরেই এক পাঠক তাদের ‘গর্দভ’ ও ‘অশ্লীল’ বলে গালিগালাজ করেন।
এরপর হারাকিরিকে বিভ্রান্তিকর ও উপহাসমূলক কন্টেন্টের জন্য ১৯৬১ সালে একবার এবং ১৯৬৬ সালে ৬ মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ১৯৬৯ সালে হারাকিরি দল মাসিক ম্যাগাজিনের স্থলে সাপ্তাহিক সাময়িকী প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়েই কাজ করার লক্ষ্যে ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু হয় ‘হারাকিরি এবদো’র।
এই হারিকিরি এবদো ১৯৭০ সালে আবারও বিতর্কিত হয় ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল নিজগ্রাম কলম্বে-লেস-ডিউক্সে মারা যান। এ ৮ দিন পরই ওই গ্রামে একটি নাইট ক্লাবে অগ্নিদুর্ঘটনায় ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়। সে সময় অন্যান্য সকল সংবাদমাধ্যমের সংবাদ প্রচারের ধরন নিয়ে বিদ্রুপ করে হারিকিরি এবদো একটি প্রচ্ছদ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল, ‘কলম্বেতে দুঃখদায়ক ঘটনা, নিহত ১।’ এ ঘটনার পর অন্যান্য গণমাধ্যমগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে এই সাপ্তাহিকীকে আবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটাতে হারাকিরি এবদো’র সম্পাদকীয় দল ম্যাগাজিনের নাম পরিবর্তন করে ‘চার্লি এবদো’ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তৎকালীন ‘পিনাট’ নামক কমিক্সের মূল চরিত্র চার্লি ব্রাউনের নাম অনুসারে এই নামটি রাখা হয়। এর পিছনেও প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল সম্পর্কেও অভ্যন্তরীণ রসিকতা ছিল যে কারণে ম্যাগাজিনটি প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
এরপর ১৯৮১ সালে আবার বন্ধ হয়ে যায় এ ম্যাগাজিনটি।
সিরিয়ার শিশু আয়লান কুর্দির কার্টুন
সিরিয়ার তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দির কার্টুন ছেপে সমালোচনার মুখে পড়ে ফ্রান্সের জনপ্রিয় ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন শার্লি এবদো। দ্য হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে শার্লি এবদোর ওই কার্টুন প্রকাশ নিয়ে তুমুল সমালোচনা করা হয়।
আয়লান সমুদ্র সৈকতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তার নিচে লেখা, "নিজের লক্ষ্যের খুব কাছে..."। পিছনে ম্যাক ডোনাল্ডের হ্যাপি মিলের বিজ্ঞাপন এবং দুটি বাচ্চা ওই হ্যাপি মিল খেতে চাইছে, কার্টুনটি আঁকা হয়েছে ঠিক এই রকমই। বিজ্ঞাপনটি দিয়ে বোঝানো হয়েছে, ক্রিশ্চিয়ান শিশুরা জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর ডুবে রয়েছে মুসলিম শিশু। আর এতেই শুরু হয় সমালোচনার ঝড়।
এ নিয়ে তুরস্কের সংবাদপত্র দ্য ডেইলি সাবা বলে, এই কার্টুন একটি শক্তিশালী উপহাস। অন্যদিকে মরক্কো বিশ্ব নিউজ লেখে, "বাক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার পিছনে আসল সত্যটাই এটা"।
শার্লি এবদোর ফেসবুক পেজেও বয়ে যায় পাঠকদের সমালোচনার ঝড়। কেউ কেউ একে 'রুচিহীন' লেখে আবার কারোর কাছে, এই কার্টুন বিরক্তির কারণ।
শেষ নবী মুহাম্মাদকে (সা.) ব্যঙ্গ করে শার্লি হেবদোর কার্টুন
ইসলাম ধর্মের শেষ নবী মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কার্টুন আঁকে ফ্রান্সের এই রম্য সাময়িকীটি। কার্টুনটি দেখানো হয়েছে, নবী (সা.) 'আমিই শার্লি' নামের একটি সাইনবোর্ড হাতে ধরে আছেন। আর এই কার্টুনের ওপর লেখা রয়েছে সব ক্ষমা করা হলো। এই পত্রিকাটি ২০০৬, ২০০৯ এবং ২০১২ সালে রাসূল (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছিল।
নবীকে (সা.) নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির দপ্তরে হামলা হয়। এই হামলায় শার্লি এবদোর সম্পাদকসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়। ওই হত্যার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে ‘জে সুইস শার্লি’ (আমি শার্লি) স্লোগান দিয়ে পত্রিকাটির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে কার্টুন
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে ইঙ্গিত করে কার্টুন আঁকে শার্লি এবদো। কার্টুনে দেখা যায়, একটি পোশাকের কারখানায় খালি গায়ে এবং ছেঁড়া প্যান্ট পরা কয়েকজন লোক টি-শার্ট সেলাই করছে। টি-শার্টের ওপর ফরাসি ভাষায় লেখা 'Je Suis Charlie' অর্থাৎ 'আমিই শার্লি'। কার্টুনে শিরোনামে লেখা, 'Pendant ce temps, au Bangladesh' - যার অর্থ অনেকটা "অন্যদিকে দেখুন বাংলাদেশে কি হচ্ছে.."
এই কার্টুন দিয়ে বোঝানো হয়েছে, শার্লি এবদোর সাথে সংহতি প্রকাশের হিড়িকে ওই স্লোগান লেখা টি-শার্টের বিক্রি বেড়েছে, এতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর ভালো ব্যবসা হচ্ছে। আর তাই, টি-শার্ট সেলাই করতে ব্যস্ত সহাস্য লোকদের একজন বলছে 'De tout coeur avec vous' অর্থাৎ 'আমরা সর্বান্ত:করণে আপনাদের সাথে আছি'।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা শিয়া ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ খোমেইনিকে নিয়ে কার্টুন
শার্লি এবদো ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তথা শিয়া ধর্মগুরু আয়োতল্লা খোমেইনিকে নিয়ে তাদের সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে একাধিক বিতর্কিত কার্টুন পোস্ট করে। এর আগে এই ধর্মগুরুর ব্যঙ্গচিত্র আঁকা নিয়ে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে শার্লি এবদো। যে যত ব্যঙ্গাত্মকভাবে আঁকতে পারবে ইরানের সর্বময় কর্তার কার্টুন, সেই পুরস্কার পাবে। ছবিগুলি প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। ইরানের সাম্প্রতিক হিজাব আন্দোলন এবং মহিলাদের রুখে দাঁড়ানোর ছাপ রেখেই নিজস্ব ভঙ্গিমায় খোমেইনিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে শার্লি এবদোর কার্টুনগুলোতে। যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছে ইরান সরকারের।
এছাড়াও আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বারাক ওবামাকে নিয়েও ব্যঙ্গ করে কার্টুন প্রকাশ করেছিল এ ম্যাগাজিনটি।