আগস্ট ২৪, ২০২২, ০৮:৪৯ এএম
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে আজ (২৪ আগস্ট) থেকে দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অফিস সময় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত শুরু হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টারে কর্মব্যস্তত শুরু হয় সকাল ৯টায় এবং কার্যক্রম চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুক্রবার ও শনিবার দুই দিন বন্ধ থাকবে। বুধবার সকাল ৮টায় অফিসে অফিসে কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে অফিস সূচিতে সরকার পরিবর্তন এনেছে, ওই উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান রয়েছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া খুব বেশি সুফল এতে পাওয়া যাবে না। তারা বলছেন, সংকটের বাইরেও এই উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার সবসময়ের জন্য একটা নীতি হওয়া উচিৎ।
সরকারি এই সিদ্ধান্তের সুফল সম্পর্কে জানতে চাইলে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম জার্মানভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "আমার প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা আগে যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেই উদ্যোগের কার্যকারিতা বা কী ফলাফল পেলাম সেটার একটা মূল্যায়ন দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, সেখানে সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অবহেলা দেখা গেছে। সেটা খুব একটা কার্যকর হয়নি। ভোক্তা পর্যায়ে লোডশেডিং দেওয়া হয়েছে, সেটা চলছে। অন্য কোনোভাবে জ্বালানি সাশ্রয়ের যে উদ্যোগ সেগুলোর ফলাফল দৃশ্যমান নয়। এখন যে সিদ্ধান্ত আসল, সেখানে এক ঘন্টা অফিস কম করলে ওই সময়ের জ্বালানি কম লাগবে। সেই জ্বালানিটা এসি ব্যবহারেই বেশি লাগে। এসি যে ব্যবহার করতেই হবে কেন? আমি যে অফিসে আছি সেখানে তো আমার মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। এসি বন্ধ না করে এসব করে লাভ কী? দিনের বেলায় তো লাইট লাগে না। আমি যে অফিসে আছি, সেখানে তো জানালা খোলা, লাইট লাগছে না।”
তিনি বলেন, “মন্ত্রী, সচিব, বড় কর্তাদের বাড়িতে অফিসে বেপরোয়াভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার হচ্ছে, সেই জায়গায় হাত না দিয়ে এমন ফরমান জারি করে কী ফল পাওয়া যাবে? এই ফরমানগুলো তো তাদের উপর এনফোর্স করা হচ্ছে না। তাহলে কীভাবে জ্বালানি সাশ্রয় হবে সেটা আমার বুঝে আসছে না। পাশাপাশি এই সেক্টরে আকাশচুম্বি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে আকাশচুম্বি মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। অযৌক্তিক ব্যয়, লুন্ঠনমূলক ব্যয় বন্ধ করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে এসব ব্যাপারে আমরা তো কোন উদ্যোগ দেখছি না। ফলে আমরা উদ্বেগের মধ্যে আছি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাকে কীভাবে আরও ইফেক্টিভ করা যায় এ মুহূর্তে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইনস্ট্যান্টলি তো বাড়ানো সম্ভব হবে না। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন বলা হয়, জরুরি পরিষেবাগুলো নতুন অফিস সময়সূচির আওতাবহির্ভূত থাকবে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, বেসরকারি অফিসের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। সব সরকারি অফিসে কোথাও কোনো পর্দা থাকবে না। এগুলো তুলে দিয়ে লাইট যতসম্ভব কম লাগলে যতটুকু চলবে এবং এয়ারকুলারও যথাসম্ভব কম ব্যবহার করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারের এই নতুন এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম. তামিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বর্তমান সংকটের বাইরেও এই উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। এটা যদি আমরা না করি তাহলে আমাদের সবসময়ই অপচয় হবে। আমরা দিনে কাজ করলাম না, রাতে লাইট জ্বালিয়ে কাজ করলাম সেটা তো গ্রহণযোগ্য না। দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার সবসময়ের জন্য একটা নীতি হওয়া উচিৎ। সেই অর্থে সাশ্রয় তো কিছুটা হবে অবশ্যই। সান্ধ্যকালীন লোডটা আশা করা যায় কমবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তামিম আরও বলেন, “ এখন সকালে মানুষকে উঠতে হবে। ৮টায় অফিস করতে গেলে ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে তাকে উঠতে হবে। এখন তো একটা-দুইটার সময় ঘুমালে চলবে না। আমাদের সন্ধ্যার পর যে কর্মকাণ্ড ছিল সেটা কমে আসবে। পৃথিবীর সব দেশে এটা করা হয়। আমাদের দেশেও একবার ঘড়ির কাটা উল্টায়ে চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের কালচারে এই উদ্যোগ সফল হওয়ার কথা না বা হয়নি। আমরা সেটা গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের আসলে অফিস-ব্যাংক বা স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে একটা গ্রীষ্মকালীন এবং একটা শীতকালীন সময় থাকা উচিৎ।”
বর্তমান সংকট থেকে সহসাই উত্তরণের কোন পথ আপনি দেখেন কিনা? জানতে চাইলে অধ্যাপক তামিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "খুব দ্রুত এখান থেকে উত্তরণের সুযোগ নেই। শীতকালেও খুব একটা ফল পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ ইউরোপেও জ্বালানির সংকট আছে। এখন আমাদের ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ লাগে। শীতকালে হয়ত এটা ১১ বা সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট লাগবে। যা এখন উৎপাদন হচ্ছে। তখনও কিছু উৎপাদন কমে যাবে। আবার শীত একটু বেশি পড়লে ৯ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। তখন হয়ত লোডশেডিং কমে আসবে। তবে এটা খুব বেশি সময়ের জন্য না। সবমিলিয়ে হয়ত ৩/৪ মাস এই সুবিধাটা পাওয়া যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের কিন্তু এখনও ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ তেলের উপর নির্ভরশীল। এটাও কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের জন্য খুব একটা খারাপ অবস্থা না। ইউরোপে এখন যে গ্যাসের দাম সেই তুলনায় এটা খারাপ না।”
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই উদ্যোগগুলোর প্রয়োজন আছে। অন্যান্য দেশেও কিন্তু এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সাংহাইতে তো বড় বড় ভবন থেকে বিদ্যুৎ কাট করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই উদ্যোগগুলো কতটা সমন্বিতভাবে করা যাচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে এর সঙ্গে কতটা যুক্ত করা যাচ্ছে সেটা দেখতে হবে। উদ্যোগ থেকে কতটা ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে সেটাও দেখতে হবে।”
ড. সেলিম রায়হান আরও বলেন, শুধুমাত্র সরকারী অফিসে সময় পরিবর্তন করে বা কমিয়ে ফলটা পাওয়া যাবে না। কারণ বেসরকারি অফিসেও অনেক বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। তাদের সময়টা কিভাবে নির্ধারিত হবে সেটা কিন্তু এখনও পরিস্কার করা হয়নি। এখন যে সময়টা নির্ধারণ করা হল, সেটাতেও একটা সমস্যাও আছে। অনেকেই সন্তানকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যেতেন। এখন একই সময়ে দু'জনকে একসঙ্গে পৌঁছাতে হবে, সেটা তো সম্ভব না।”
স্কুলের সময়ের এক ঘন্টা পরে অফিসের সময় নির্ধারণ করার পক্ষে মত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, “সবমিলিয়ে এসব উদ্যোগের প্রয়োজন আছে। এটা সমন্বিতভাবে করা দরকার। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তবে সহসাই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সুযোগ নেই। তবে শীতে গরম কমে গেলে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসছে। ফলে এখানেও সমন্বয় করার সময় এসেছে বলেই আমি মনে করি। তবে এই পরিস্থিতিতে শীতকালে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে বলে মনে হচ্ছে।” সূত্র: ডয়চে ভেলে।