ধর্ষণ মামলায় আওয়ামী লীগ এমপির ভাই, রাজনীতির উত্তাপ ছড়াচ্ছে টাঙ্গাইলে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১১, ২০২৩, ০৯:৫৫ পিএম

ধর্ষণ মামলায় আওয়ামী লীগ এমপির ভাই, রাজনীতির উত্তাপ ছড়াচ্ছে টাঙ্গাইলে

টাঙ্গাইল শাখা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনিরের বিরুদ্ধে এক কিশোরী ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন। বড় মনি হচ্ছেন মনির টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের বড় ভাই। পুলিশ এখনো বড় মনিরকে গ্রেপ্তার না করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কোন্দল চরমে উঠেছে। এ ঘটনায় ছোট মনির বেশ চাপে পড়েছেন তার নির্বাচনী এলাকায়। দলের ভেতরে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এই ধর্ষণকে কেন্দ্র করে মাঠে নেমেছেন। তবে ছোট মনিরও তাঁর পক্ষের লোকজনকে মাঠে নামিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন।

টাঙ্গাইলে বড় মনিরকে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে বিক্ষোভ করেন নারীরা। ছবি: সংগৃহীত

ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ রাজনীতি দুই শিবিরে বিভক্ত থাকলেও কয়েক বছর আগে বাবা-মা হারানো ভুক্তভোগী ওই কিশোরীর দাবি, রাজনীতি নয়, তিনি চান ন্যায়বিচার। 

টাঙ্গাইল শহর এবং গোপালপুর-ভূঞাপুর এলাকায় এখন এমপির ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলাই প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভক্তি চরম আকার ধারণ করেছে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বিচারের চেয়ে কে কাকে ঘায়েল করবে—সেটাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য।

টাঙ্গাইল সদর থানায় গত বুধবার (৫ এপ্রিল) রাতে ওই কিশোরী বড় মনিরের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দায়ের করে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৭ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল শহরের আদালত পাড়ায় নিজের বাড়ির পাশের একটি ভবনে ওই কিশোরীকে ডেকে নেন বড় মনির। সেখানে তাঁর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। পরে তাঁকে ধর্ষণ করে তাঁর আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হয়। বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য তাঁকে ভয়ভীতি দেখান তিনি।

এরপর আপত্তিকর ওই ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

এক পর্যায়ে ওই কিশোরী অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়েন। বিষয়টি জানার পর গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিশোরী রাজি না হওয়ায় গত ২৯ মার্চ রাত আটটার দিকে বড় মনির ওই কিশোরী তুলে নিয়ে আদালত পাড়ার একটি বাড়িতে যান। সেখানে একটি কক্ষে তাঁকে তালাবদ্ধ করে রেখে বড় মনির আবার ধর্ষণ করেন। এই ঘটনার পর বড় মনিরের স্ত্রী নিগার আফতাব কিশোরীকে মারধর করেন। পরে দিবাগত রাত তিনটার দিকে ওই কিশোরীকে বাড়িতে রেখে আসা হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার জন্য মামলা করতে দেরি হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

কিশোরী যা বললেন

ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী বলেছেন, ‘‘তারা আমার আত্মীয়, কিন্তু তাদের বাড়িতে আমি থাকতাম না। শুধু আমি একা নই, আরো অনেক নারী তাঁর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমি নিজে তা জানি। আমি চাই আর যেন কোনো নারী এই পরিস্থিতির শিকার না হন। এ জন্যই আমি মামলা করেছি। আমি ন্যায়বিচার চাই। আশা করি ন্যায়বিচার পাবো।”

কিশোরী বলেন, ‘‘মামলার পর আমার জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে এবং ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে মামলা আদালতে যাওয়ার পর আমি আবার ডাক্তারি পরীক্ষার আবেদন করবো। শারীরিকভাবে আমি এখন খুবই অসুস্থ। আমি এখনো কোনো চাপের মুখে নাই। তবে ভবিষ্যতে কী হয় জানি না।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি রাজনীতি করি না। যারা এটা নিয়ে রাজনীতি করছেন সেটা তাদের ব্যাপার। আমি চাই ন্যায়বিচার।”

Boro Monir

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে বড় মনিরকে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে ঝাড়ুমিছিল করেন স্থানীয় নারী সমাজ। ছবি: সংগৃহীত

মামলাটি মিথ্যা, দাবি ছোট মনিরের

ধর্ষণ মামলা মিথ্যা বলে দাবি করেছেন সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির। জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ছোট মনির দাবি করেছেন, ধর্ষণের মামলাটি মিথ্যা। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তাঁকে দিয়ে মামলাটি করিয়েছে। ওই মেয়েটি আমাদের আত্মীয়। তাঁর মা-বাবা নেই। আমার ভাবী তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এখন আমাদের প্রতিপক্ষই তাঁকে কাজে লাগাচ্ছে। সামনে আমার জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আবার আমার ছোট ভাই জেলা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী। সব মিলিয়ে আমাদের ঘায়েল করার জন্য এসব করা হচ্ছে।’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘মামলার তদন্ত হচ্ছে। অবশ্যই আমার ভাই এটাকে আইনগভাবে মোকাবিলা করবেন। তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, তাঁর মামলা তিনিই দেখবেন। সময় হলে আদালতে আত্মসমর্পণও করবেন। আমি মামলার ব্যাপারে প্রশাসনের কারো সাথে কোনো কথাও বলিনি। তারপও আমাকেই কেন টার্গেট করা হচ্ছে!”

ভূঞাপুর আওয়ামী লীগ সভাপতি যা বলেন

তবে ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র মাসুদুল হক বলছেন, ‘‘আমরা সংসদ সদস্যের বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা নিয়ে খুবই বিব্রত। সবাই ছি ছি করছে। এটা আমাদের দলের জন্যও অস্বস্তিকর। এলাকার মানুষ ধিক্কার দিচ্ছে। ন্যাক্কারজনক কাজ।”

তিনি বলেন, "সাধারণ মানুষ এবং নারী সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, বিচার দাবি করছেন। আমরাও দাবি করি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিলে তো জেলা কমিটিকে নিতে হবে। তাঁর ভাই (ছোট মনির) আবার জেলা কমিটির নেতা। ব্যবস্থা কি নিতে পারবে!”

মাসুদুল হক আরও বলেন, ‘‘ছোট মনির হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। এখানকার রাজনীতিতে তার অতীত কোনো কাজ নেই। হঠাৎ করেই এমপি হয়েছেন। তাই দলের মর্যাদার কী বুঝবেন?”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তার ভাই তো পলাতক। পুলিশ চেষ্টা করছে তাঁকে গ্রেপ্তারের। তবে শুনেছি তিনি এরই মধ্যে দেশের বাইরে চলে গেছেন। আর এমপি সাহেবও ঢাকায় আছেন।”

আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে: টাঙ্গাইল সদর থানা

ধর্ষণের মামলায় আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ. ছালাম মিয়া। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘মামলার তদন্ত ও আসামিকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। আমরা মামলা নেওয়ার পর ভিকটিমের জবানবন্দি, ডাক্তারি পরীক্ষা শেষ করে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে তাঁর ফুপুর জিম্মায় দিয়েছি। তাঁর নিরাপত্তার দিকে আমরা খেয়াল রাখছি।”

ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন তারা এখনো পাননি। তবে দুই-একদিনের মধ্যে পেয়ে যাবেন বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Link copied!