ফেব্রয়ারি মাস। দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মাসটির পরিচিতি ‘ভাষার মাস’ হিসেবে। বুধবার থেকে শুরু হলো রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি মাস। এই মাসের প্রথম দিন থেকে ধ্বনিত হবে প্রয়াত সাংবাদিক কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ নামে অমর সংগীতের অমিয় বাণী। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবিতে যারা রাজপথে রক্ত দিয়েছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন বাঙালি জাতি পুরো মাসজুড়ে তাদের ভালোবাসা জানাবে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে চৌধুরী খালেকুজ্জামান ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব করেন। তবে তাদের এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করেন ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হক সহ আরো বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী।
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে একই বছরের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অঅবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি উত্থাপন করে এই প্রতিষ্ঠানটি।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার গণপরিষদের সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কামরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ঘোষণা দেন যে “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। সমবেত ছাত্র-জনতা এর প্রতিবাদ জানায় উভয় স্থানেই।
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একই মাসের ৩১ জানুয়ারি সকল রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক দলকে নিয়ে গঠন করা হয় “সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। সংগঠনটির আহবায়ক হন কাজী গোলাম মাহবুব হন। এই কমিটি এক সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সারাদেশে হরতাল আহ্বান করে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে নুরুল আমিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। তবে ২১ ফেব্রুয়ারির দিন বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে ছাত্র-জনতা সমবেত হয়ে স্লোগান দিয়ে মিছিল শুরু করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে মারা যান সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ বেশ কয়েকজন। তাদের রক্তের বিনিময়ে বিনিময়ে বাঙালি জাঁতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
প্রতিবছরের মতো এবারও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর শুরু হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবার হয়ে উঠছে জমজমাট।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন বুধবার থেকে বড় কর্মযজ্ঞ মাসব্যাপী বইমেলা শুরু হচ্ছে। বাংলা একাডেমিতে বিকেল তিনটায় এই মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলা একাডেমির সভাপতি বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতিপ্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
বইমেলার পাশাপাশি জাতীয় কবিতা উৎসবও শুরু হচ্ছে বুধবার থেকে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খল মুক্তির ডাক দিয়ে ১৯৮৭ সালে শুরু হয় এ ঊৎসবের। ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলাদেশ পথ-নাটক পরিষদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করেছে এ পথ নাট্যোৎসবের। এছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে।