“আমরা বিকেল বেলা খেলাধুলা করে বাসায় যাই। সকালে এসে দেখি মাঠে ঢুকার কোন গেইট নেই। পুরো মাঠ টিন দিয়ে ঘেরাও করে আটকিয়ে রাখা হয়েছে।” এভাবে রাতের অন্ধকারে মাঠ দখল হয়ে যাওয়ার কথা জানান রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা মেহেদী হাসান জনি।
তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে আরও বলেন, ”২০০৭ সালের শেষের দিকে আনসাররা এসেই এই মাঠে একটা ক্যাম্প করে। সেই ক্যাম্পে তারা অসহায়-দুস্থদের বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ দেয়ার কাজ করে। সেই সময়ও আমরা মাঠের যেই অংশ ফাঁকা ছিলো সেখানে খেলাধূলা করতাম। হঠাৎ একদিন সকালে দেখি পুরো মাঠ টিন দিয়ে ঘেরাও করা। ভিতরে ঢুকার কোন রাস্তা নেই।”
মাঠ দখল মুক্ত করার আন্দোলন করতে গেলে বিভিন্ন ধরনের হামলা-মামলার শিকার হন ওই এলাকার বাসিন্দারা। এমনই এক বাসিন্দা কামাল আহমেদ দুলু। জন্মলগ্ন থেকেই তিনি খিলগাঁও এলাকায় বসবাস করেন। সবুজ সংঘে মাঠেই তিনি খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন। মাঠ দখল হওয়ার পর আন্দোলন শুরু হলে বিভিন্ন ধরনের হামলা-মামলার শিকার হন তিনি।
ওই সময়ের ঘটনা জানতে চাইলে কামাল আহমেদ দিলু বলেন, “এই মাঠটাকে আমরা পচার মাঠ নামে চিনতাম। বিএনপির সময় এই মাঠটা শিশু পার্ক হয়। তখন থেকে এটি ‘সবুজ সংঘ মাঠ’ নামে পরিচিত। এরপর আমরা দেখি রেশনিংয়ের নাম করে এই মাঠে ক্যাম্প করে। হঠাৎ তারা পুরো মাঠ আটকায় দেয়। তারপর আমরা যখন মাঠ উদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু করি সে সময় আমাদের উপর হামলা চালায়। অনেকের নামে মামলা পর্যন্ত করা হয়।”
মাঠটি ১৯৮৭ সালে আনসার-ভিডিপি কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে সেই ইজারা বাতিল করা হলে সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরই হাই কোর্টে রিট করে আনসার কর্তৃপক্ষ। তবে ২০১৮ সালে ওই রিট আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়।
আনসার ভিডিপির ইজারা বাতিলের চার বছর পর স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ‘সবুজমতি ট্রাস্টের’নামে ইজারা নেয় মাঠটি। পরে এলাকাবাসীর দাবির মুখে ২০০৪ সালে সেই ইজারাও বাতিল করা হয়।
সবুজমতি ট্রাস্টের ইজারা বাতিলের পর ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আনসার-ভিডিপি পার্কটি দখলে নেয়। ২০০৮ সালে মাঠটি দখলমুক্ত করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সেই রিটের পরিপেক্ষিতে হাইকোর্ট ৯০ দিনের মধ্যে দখলমুক্ত করার পাশাপাশি এক বছরের মধ্যে দুই বিঘা জমির এই মাঠটিকে আধুনিক, সুন্দর শিশুপার্ক হিসেবে গড়ে তুলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এই রায়ের পরদিনই আনসার-ভিডিপি সেই রায়ের বিপক্ষে আপিল বিভাগের চেম্বার জাজের কাছে আবেদন করেন। চেম্বার জাজ তখন হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন।
এ বিষয়ে আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, “হাইকোর্টের রায়ে আনসারদেরকে ওই জায়গা থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে। আর খেলার মাঠটা ব্যবস্থাপনা করতে বলা হয়েছে। ওই রায়ের বিপক্ষে আপিল বিভাগের চেম্বার জাজের আনসারবাহিনী আবেদন করলে চেম্বার জাজ তখন হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। এখন এটা আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের শুনানির অপেক্ষায় আছে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সম্পত্তি বিভাগের তথ্য বলছে মাঠটি এখনো খিলগাঁওয়ের গণপূর্ত বিভাগ-৪ এর আওতায়। যা এখনো সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। এই বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ”হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে আমরা চিঠিপত্র দিয়েছি। কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তর আমাদের মাঠ বুঝিয়ে দেয়নি। তারা বুঝিয়ে দিলে এটি খেলা মাঠ ও শিশুপার্ক করা যাবে।”
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ”আমাদের মূল মাস্টারপ্ল্যানে এটা মাঠ ছিল না, প্লট ছিল। জায়গা খালি থাকায় বাচ্চারা খেলাধুলা করতো। এখন যেহেতু এখানে আনসার-ভিডিপি সাব স্টেশন করে ফেলছে তাই আমরা এটার বিকল্প হিসেবে হাজিপাড়ায় খেলার মাঠ ও ঈদগা করে দিবো। এ ছাড়া আপিল বিভাগ যে সিদ্ধান্ত নিবে, সেটাও কার্যকর করা হবে।”
তবে মাঠ দখল বিষয় কথা বলার জন্য বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মিজানুর রহমান শামীমের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সংস্থাটির খিলগাঁও সদর দপ্তরে যোগাযোগ করলে জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে সংস্থাটির আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আব্দুর রব দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ”মালিবাগ আবুল হোটেল সংলগ্ন আনসার মাঠ নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে। এটা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। উচ্চ আদালত যে রায় দেয়, সেটাই আমরা মেনে নেবো।”