চলতি মাসে গুলশানে এক কনস্টেবলকে আরেক কনস্টেবলের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেও ‘ওভারটাইম ভাতা’ না পাওয়া, থাকা-খাওয়ার পরিবেশ খারাপ হওয়া, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার প্রভৃতি কারণে পুলিশ কনস্টেবলদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। বাড়ছে পারিবারিক বিবাদ।
এ-সংক্রান্ত বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সদস্য জানান, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা কিংবা কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেও ‘ওভারটাইম ভাতা’ না পাওয়া, থাকা-খাওয়ার পরিবেশ খারাপ হওয়া, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি ও বদলিজনিত বঞ্চনা- এইসব মিলিয়ে মাঠ-পর্যায়ে দায়িত্বপালনকারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রায়ই ঘটছে পারিবারিক বিবাদ, বিবাহবিচ্ছেদ ও আত্মহত্যার ঘটনা।
তারা আরও জানান, কনস্টেবলদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ব্যারাকে থাকেন। সেখানে থাকা-খাওয়ার পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। এখানে থেকে-খেয়ে যে কারও পক্ষে ১০-১২ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করা কষ্টকর।
তাদের অভিযোগ, সুযোগ-সুবিধার সব উদ্যোগ পুলিশ ক্যাডারদের ঘিরে। সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মাঠ-পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয় না। থাকা-খাওয়া, পদোন্নতি-বদলির ক্ষেত্রে এই বঞ্চনা কমানো না গেলে ভবিষ্যতে মাঠ-পুলিশে ‘গুলশানের’ মতো অপরাধের ঘটনা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নেই মাথাব্যথা
এসব পুলিশ সদস্য চাকরি করতে গিয়ে বঞ্চনার শিকার হলেও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলিত থাকছে। গত ৯ জুন রাজধানীর গুলশানে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে সহকর্মীর দিকে পুলিশ সদস্যের গুলি ছোড়ার ঘটনার নতুন করে বিষয়টি সামনে এসেছে।
এর আগে গত বছর রাজধানীর বনানীর একটি তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্ব পালনের সময় আশরাফুজ্জামান রনি (২২) নামে এক পুলিশ সদস্য নিজের বুকে গুলি করে ‘আত্মহত্যা’ করেন। একই বছর পঞ্চগড়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে ‘আত্মহত্যা’ করেন ফিরোজ আহমেদ (২৭) নামে আরেক পুলিশ সদস্য।
মাঠপর্যায়ে কর্মরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের দিনে ১০-১২ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজ শেষে ব্যারাকে ফিরেও ভালো খাবার ও থাকার ব্যবস্থা পান না তারা। এই যখন অবস্থা, তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখবে কে?
তারা আরও বলেন, এখন রাজনৈতিক বিবেচনা ও ঘুষ ছাড়া পদোন্নতি, ভালো জায়গায় বদলি হওয়া যায় না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করেন। সব মিলিয়ে শারীরিক-মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা মাঠ-পুলিশ সদস্যরা ভালো নেই।
সংস্কারে নানা প্রস্তাব থাকলেও নেই বাস্তবায়ন
২০২০ সালে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেখানে ‘রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন’ ও ‘জনগণের পুলিশ’ গঠনে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, আবাসন, চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষা, আচরণ, দুর্নীতি ও নারী সদস্যদের সমস্যা সমাধানে একটি গবেষণা করে পুলিশ সদর দপ্তর।
গবেষণায় পুলিশের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে ১৩ ধরনের মতামত দেন এতে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যরা। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং ওভারটাইম ভাতা দেওয়া, বার্ষিক ছুটি বাড়ানো, শহীদ পুলিশ সদস্যদের পরিবারের জন্য আজীবন রেশন-ব্যবস্থা চালু, রোগতত্ত্ব ইউনিট তৈরি, চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতকরণের মতো বিষয়গুলো উঠে আসে।
এতে আরও উঠে আসে, পুলিশের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দুরবস্থার চিত্রও। এর পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণায় চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ১৩টি প্রস্তাব করা হয়। উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবের মধ্যে ছিল ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ছুটি, বিনোদন, খেলাধুলার সময় নির্দিষ্ট করা।
কিন্তু চার বছর পরও মাঠপর্যায়ে পুলিশের বঞ্চনার অবসান, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমকে গবেষণাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “সামগ্রিকভাবেই সারা দেশের মানুষের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। পুলিশ সদস্যরাও এই সমাজের একটি অংশ। সে জন্য এর প্রভাব পুলিশের মধ্যে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “পুলিশ বাহিনীতে ইতিবাচক পরিবর্তনে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অনেক বিষয় বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবে মাঠ পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয় এখনো অনেকাংশেই অবহেলিত রয়ে গেছে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, “যখন পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন মৌলিক প্রশিক্ষণে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এরপর দীর্ঘ চাকরি জীবনে ইনসার্ভিস প্রশিক্ষণেও কীভাবে মানসিক চাপ মোকাবিলা করা যায়, সেটা শেখানো হয়, কাউন্সেলিং করা হয়।”
গুলশানের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা দাবি করে, “যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য প্রয়োজনে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের চর্চা আরও বাড়ানো হবে।”
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “পুলিশ সদস্যদের সব সময় মানসিক চাপের কাজ করতে হয়। তাই নিয়োগের সময় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিকভাবে তিনি পুলিশের চাকরির জন্য ফিট (সক্ষম) কি না, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। চাকরিকালে কোনো পুলিশ সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটল কি না, সেটা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”
উল্লেখ্য, গত ৯ জুন রাজধানীর গুলশানে ফিলিস্তিনের দূতাবাসের সামনে এক পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন আরেক পুলিশ সদস্য। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের নাম- কনস্টেবল কাওসার আলী। আর যাকে হত্যা করা হয় তিনি হলেন মো. মনিরুল ইসলাম।